“আমার মন বসে না শহরে, ইট পাথরের নগরে/তাই তো আইলাম সাগরে…’’ গানটি লেখা বাংলাদেশের শিল্পী তাশরিফ খানের। তাশরিফ নিজেকে আগে একজন সমাজকর্মী এবং তারপর সঙ্গীতশিল্পী বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। ‘কুঁড়েঘর’ ব্যান্ডের গায়ক তাশরিফ সমস্ত প্রতিকূলতায় মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেন। সমাজসেবা মূলক বিভিন্ন কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত। কিন্তু, তিনি কি জানতেন দুই বাংলা সহ পৃথিবীর মানুষের কাছে তাঁর ওই গান পৌঁছে যাবে? সারা বাংলাদেশ সহ আজ ভারতের মানুষও “এই সাগর পারে আইসা আমার মাতাল মাতাল লাগে” বলে নেচে উঠছেন। কেন? কারণ ছোট্ট সাইফ ইসলাম।
বাংলাদেশের কক্সবাজারের ছেলে সাইফ। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতেরই কোনো ট্যুরিস্টের মুঠোফোনে বন্দি হয়েছিল সাইফের ‘মন বসে না শহরে’ গানটি গাওয়ার দৃশ্য। বাকিটা ইতিহাস। তার কচি কন্ঠের জাদুতে মেতে উঠেছে ইন্টারনেট দুনিয়া। ইন্টারনেটের ভাষায় যাকে বলে ‘ভাইরাল হওয়া’। কক্সবাজারের অধিকাংশ দুঃস্থ পরিবারগুলির জীবিকা মূলত: সমুদ্রকে ঘিরেই। মুক্তো, ঝিনুক কুড়িয়ে, মাছের ব্যবসা করে, বার্মা থেকে আসা আচার, জুতো ইত্যাদির ব্যবসা করে দিন কাটে। দশ-এগারো বছরের সাইফও সেইরকম দরিদ্র পরিবারেরই ছেলে। তাশরিফ খান নিজেই জানান, সাইফ সমুদ্র সৈকতে খেলনা বিক্রি করে পরিবার চালায়।
বর্তমানে সাইফের জনপ্রিয়তার কারণে প্রতিদিন এসে হাজির হচ্ছেন অসংখ্য ইউটিউবার, ভ্লগারদের দল। লক্ষ্য সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘ভিউ’ পাওয়া। ক্যামেরা ধরেই এঁরা ছোট্ট সাইফের হাতে গুঁজে দিচ্ছেন টাকা। ভিউ হচ্ছে মিলিয়ন-বিলিয়ন। পূর্বে আমরা এভাবেই গান গেয়ে, নাচ করে ‘ভাইরাল’ হতে দেখেছি বিভিন্ন শ্রেণীর প্রান্তিক মানুষদের। অবিশ্যি রাণু মন্ডল বা ভুবন বাদ্যকরদের থেকে সাইফ ইসলামের মূল পার্থক্য হল বয়স। এই ছোট বয়সে সাইফকে খেলনা বিক্রি করতে হচ্ছে কেন, সেই প্রশ্ন উঠছে না।
কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই ছোট্ট সাইফ যে প্রতিভার অধিকারী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার প্রতিভার যে পরিচয় উঠে এসেছে, তা অবিশ্বাস্য। কিন্তু তস্য গরিব পরিবারের ছেলে সাইফ বা সাইফের মতই আরো প্রতিভাশালী বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ আসলে কি? সাইফ কেন স্কুলে পড়াশোনা করার বয়সে, শেখার বয়সে সমুদ্র সৈকতে ব্যবসা করতে নেমেছে? ইউটিউবার বা ভ্লগারদের দান করা টাকাপয়সা কি সাইফের ভবিষ্যতের বদল ঘটাবে? বড় হয়ে সাইফ কি তার শিল্পকে প্রকাশের সুযোগটুকুও পাবে? এই প্রশ্নগুলিই বারবার উঠে আসে, যখন ছোট্ট সাইফ গেয়ে ওঠে, “এই নীল জলেতে ভাসায়ে দিবো/ মনের দুঃখ যতো/ আর জল দিয়া পূরণ করিবো/ হাজার শুকনো ক্ষত।’’
Discussion about this post