বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরণা আর আন্তরিক সহযোগিতায় ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফুটবল মাঠে গড়ায় মাত্র দু’মাসের মধ্যেই। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল ম্যাচ। তৎকালীন ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) দেশের তারকা ফুটবলারদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ একাদশ ও রাষ্ট্রপতি একাদশের মধ্যে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা দল কলকাতা মোহনবাগান ঢাকায় খেলতে আসে ১৯৭২ সালের মে মাসে।
১০ মে ১৯৭২ ঢাকা বিমানবন্দরে নেমেই মোহনবাগানের ম্যানেজার করুণা ভট্টাচার্য আবেগে আপ্লূত হয়ে পড়েন। তিনি বললেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের জন্য মৈত্রী, শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা নিয়ে ওপার বাংলা থেকে এসেছি।’ ভারতীয় ফুটবল দলের দুই সাবেক অধিনায়ক শৈলেন মান্না ও চুনী গোস্বামীও এই দলের সঙ্গে কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকায় আসেন। ময়মনসিংহে যাঁর পূর্বপুরুষের ভিটামাটি, সেই চুনী গোস্বামীর সেটিই ছিল প্রথমবার ঢাকায় আসা। ১১ মে, ১৯৭২ অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ঢাকা স্টেডিয়ামে ম্যাচের আগে টস করেন ভারতের মোহনবাগানের অধিনায়ক পি গাঙ্গুলী ও বাংলাদেশের মোহামেডানের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। মোহনবাগান ম্যাচে ১১টি কর্নার পেয়েছিল। কিন্তু গোল তারা পাচ্ছিল না। গোলের চেষ্টা করছিল মোহামেডানও। প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে সাদা কালোরা সুযোগ তৈরি করেছে বেশি। এর মধ্যে গোলাম সারোয়ার টিপু ও কাজী সালাউদ্দিন দুটি ভালো সুযোগ তৈরি করেছিলেন। তবে এই অর্ধে কাজের কাজটি করে মোহনবাগান। ফরোয়ার্ড অশোক চ্যাটার্জির গোলে তারা জেতে ম্যাচটি (১-০)।
ম্যাচে কোনো সৌজন্য টিকিট রাখা হয়নি। কারণ, এ ম্যাচ আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সহায়তা করা। টিকিটের মূল্য ছিল পূর্ব দিকের গ্যালারি ১ টাকা, পশ্চিম দিকে ২ টাকা। ৩৫ হাজারের বেশি দর্শক সেদিন হয়েছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে। ম্যাচের উদ্বোধন করেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী। ঐতিহাসিক এ ম্যাচের শুরুতে ও বিরতির সময় দর্শকদের জন্য বাড়তি পাওনা ছিল ব্যান্ড পার্টির বাদ্যবাজনা। মোহনবাগানের সেই দলে ছিলেন আটজন আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার। তবে নজর কাড়েন শুধু অশোক চ্যাটার্জি, এস সেন গুপ্ত, এস ঘোষ, দস্তিদার, সি গুপ্ত। রক্ষণে ভালো খেলেন নিমাহ গোস্বামী ও বি মিত্র। মোহামেডানের কায়কোবাদ, আইনুল, নান্নু ছাড়া অন্যরা আলো ছড়াতে পারেননি। মঈন, হাফিজ, শামসুররা ছিলেন ব্যর্থ।
এরপর ১৩ ই মে ১৯৭২। শনিবার, বিকেল সাড়ে চারটা। দ্বিতীয় প্রীতি ম্যাচে ঢাকা একাদশ নামে মোহনবাগানের বিপক্ষে খেলেছে আসলে বাংলাদেশের নির্বাচিত সেরা একাদশ। সেটিই ছিল তখনকার অলিখিত বাংলাদেশ জাতীয় দল। ম্যাচ শুরুর আগে দুই দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে হতাশ করেননি ঘরের ছেলেরা। ১-০ গোলে জিতল ঢাকা একাদশ। কোনো বিদেশি দলের বিপক্ষে এটিই বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক জাতীয় দলের প্রথম জয়। ৬৮ মিনিটে তরুণ ফরোয়ার্ড কাজী সালাউদ্দিন ঢাকা একাদশের গোলটি করেন। সেই গোল নিয়ে উচ্ছ্বসিত চুনী গোস্বামী ম্যাচ শেষে বলেছিলেন, ‘এটা ছিল দুর্দান্ত এক গোল।’ মোহনবাগানের দলনেতা বলেন, “আমার দেখা অন্যতম সেরা গোল এটি।”
Discussion about this post