ছবি – ফাইল চিত্র
কলমে মৈনাক মাইতি
আপাতত মীরাবাঈ ‘ভারতীয়’, ‘চিঙ্কি’ নয়! পরশুদিনই রাস্তায় ছোটো চোখ আর ওঠানো ভ্রু দেখলেই কমন নাউন ‘চিঙ্কি’ মুখ দিয়ে বেরোবে। তরশু সামনে মীরাবাঈ চ’লে এলেও চিনতে পারবো না, অবলীলায় কমন নাউনের আশ্রয় নেব। মীরাবাঈয়ের রূপো নিয়ে সোশাল মিডিয়া এবং মিডিয়ায় সংবর্ধনা দিয়ে ফাটিয়ে দেবেন। অনুরাগ ঠাকুর আর নিশীথ প্রামাণিককে এক ছবিতে নিয়ে এমন অভিনন্দন দেবেন যে মনে হবে আসলে তিনিই তুলেছেন। আজ মণিপুর ‘খুব’ ভারতের। কাল থেকে আবার আর্মি দিয়ে মোড়া মণিপুর মূল ভূখণ্ডের একটু বাইরে।
আমরা ঠিক ছ’মাসের ভেতর মীরাবাঈকে ভুলে যাবো, যেভাবে কর্ণম মালেশ্বরীকে ভুলে গিয়েছিলাম। রিও অলিম্পিক্সের ঠিক আগে চোট পেয়ে বেরিয়ে গিয়ে চার চারটে বছর লাইমলাইট আর গুগল সার্চের বাইরে যেভাবে তিলে তিলে প্রতিদিন অমানুষিক পরিশ্রম ক’রে নিজেকে গ’ড়ে তুলেছেন মীরাবাঈ, হঠাৎ ক’রে আজকে গুগল সার্চে প্রথম হয়ে উঠবেন। আমরা মেধা তালিকার নগ্ন গ্রাহক। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক হোক আর অলিম্পিকের পদক তালিকা। ৭৯ জন প্রথম কিংবা যদি কোনোদিন মেধাতালিকাই না বেরোয়, তাহলে আমাদের শিরে সংক্রান্তি! চুপচাপ পরিশ্রমের কোনো গ্লোরি নেই, তার কেবল ট্র্যাজেডি আর রূপকথার গল্পে ঠাঁই। বাস্তবে আমাদের মাথাব্যথা কারা তালিকায় আছেন সেটা নিয়ে। আর মাথাব্যথা যেটাকে আমরা ঘেরাটোপ ক’রে নিয়েছি সেটা নিয়ে। মানে ক্রিকেট। তাই এখন ওয়ার্ম আপ ম্যাচও আমরা দেখি। মীরাবাঈয়ের ওয়ার্ম আপ অনুশীলন বাদ দেওয়া যাক, ক্লিন অ্যান্ড জার্কে বিশ্বরেকর্ডধারী ১১৯ কেজি ভারত্তোলনের হাইলাইটস (লাইভের কথা ধরছিই না), আমরা কতজন দেখেছি? পদক তালিকা কী হবে সেটা দেশের সংস্কৃতি, সরকারের নীতি এবং সমষ্টিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল।
আমরা নিজে থেকে এই দাবীটা কখনোই তুলবো না যে মণিপুরকে আফস্পা মুক্ত করে সেনায় মুড়ে রাখা বন্ধ করে মুক্ত করা হোক। তুলবো না, গড় পুষ্টি বাড়ানোর কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হোক। বলব না, যে মণিপুর এই মুহূর্তে ভারতের ক্রীড়া-সংস্কৃতিতে সবথেকে এগিয়ে থাকা রাজ্য, সেখানকার মানুষ সম্পর্কে সামাজিক অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গি দূর হোক। ভাববো না, গোটা দেশটাকে নিয়েই এরকমভাবে ভাবা শুরু হোক। কারণ এটা কঠিন কাজ। মীরাবাঈয়ের প্রায় ৬ বছর নিভৃতবাসে থেকে তিলে তিলে নিজেকে গড়ার মতো। অথচ এরকমটা হলে, পরেরবার মীরাবাঈ স্ন্যাচেও হয়তো হু ঝি ঝু’র ৯৬ কেজি থেকে বেশী তুলে অলিম্পিক রেকর্ড গড়তে পারবে। পারবে ক্লিন অ্যান্ড জার্কে নিজেরই গড়া ১১৯ কেজির বিশ্বরেকর্ড ভেঙে নতুন বিশ্বরেকর্ড এবং অলিম্পিক রেকর্ড গড়তে। কিন্তু দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতের অলিম্পিক ইতিহাস দপ ক’রে জ্বলে উঠে নিভে যাওয়ার ইতিহাস। মীরাবাঈ নিজেকে ধ’রে রাখতে পারলে নিজের কারণে পারবে, আমাদের কারণে নয়।
আর আজ অন্যান্য ইভেন্টে যারা হেরে গেছে, কাল যারা যাবে, তাদের আমরা চিনবোও না, তাদের দিকে ফিরেও তাকাবো না। আমরা জ্যান্ত মীরাবাঈকে চিনি না, মীরাবাঈয়ের রূপোর মৃত পদকটাকেই চিনি। আর এটাই পুঁজিপতি থেকে স্বঘোষিত নেতারা চায়। কারণ এটাই আমাদের ব্যবহার ক’রে নেওয়ার ভিত্তি।কবীর সুমন সেনাবাহিনীকে দেশপ্রেমের দিনমজুর নাম দিয়েছিলেন। আজকের সাইবার দুনিয়ার বাস্তবতায় আমরা, ক্রীড়াপ্রেমীরাও, দেশপ্রেমের দিনমজুরিই ক’রে থাকি মূলতঃ। দেশপ্রেমের নীতি-নির্ধারণ অন্য কেউ করবে আর আমরা কেবল দিনমজুরিই ক’রে যাবো। যে দিনমজুর, সেই যদি নীতি-নির্ধারণ ক’রে, তাহলে সেই দেশপ্রেম স্বাদে গন্ধে বর্ণে অনন্য হয়ে উঠবে! সেরকম দেশপ্রেমের স্বপ্নও কি আমরা দেখতে পারি না?
Discussion about this post