প্রতিবেদক – সুরাইয়া শারমিন
আমাদের ছোট বেলাটা ছিলো একদম অসাম্প্রদায়িক। আমরা কখনো আব্বা- আম্মার মুখে শুনি নাই ওরা হিন্দু, ওরা খ্রিস্টান, ওরা বৌদ্ধ ধর্মের ওদের বাসায় যাওয়া-আসা বা খাওয়া যাবে না। আশ্বিন মাস ছিলো ছোট বেলার একটা বিশেষ মাস। কারণ সেই মাসে হতো দুর্গাপূজা। আমার ছোট বোলার প্রতিক্ষার মাস ছিলো আশ্বিন। কী যে আনন্দ হতো পুর্জার ছুটি হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে। কারণ দুর্গাপুজার সময় প্রতিদিন আব্বা আমাদের নিয়ে যেতো প্রতিমা দেখার জন্য। কী যে আনন্দ হতো! দুর্গাপূজায় আমরা যেতাম টিবি হসপিটালের ভিতরে কর্মচারীদের কোয়ার্টারের সামনে অনেক বড় ফাঁকা জায়গা ছিলো, সেখানে পূজা মন্ডপ তৈরি করা হতো। আমার দু’চোখে সব চাইতে বেশি সুন্দরী ছিলো দেবী ‘দুর্গা আর তাঁর দুই মেয়ে লক্ষী আর সরস্বতী।
আর তাদের জাঁকজমকপূর্ণ সাজ। তাদের শাড়ি থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারতাম না। আমার কাছে সব চাইতে বেশি সুন্দর লাগতো বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে তার শুভ্র বসন আমাকে বেশি টানতো। আমার দেখা ছোট বেলার দুর্গা পুজায় দেবী দুর্গাকে পরানো হতো টকটকে লাল শাড়ি। লক্ষ্মী দেবীকে নীল শাড়ি, আর বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে সাদা শাড়ি। হয়তো বা ছোট বেলায় আমি আমার পছন্দকে নির্ধারণ করেছিলাম, তাই তো আমার বেশির ভাগ শাড়িই ছিলো সাদা। আমি ছোট বেলায় সব চাইতে বেশি পুতুল খেলেছি। আমার পুতুলের জামা বানানো, শাড়ি বানানো ওদের ঘর গুছানো, আর ওদের জন্য লাল, নীল পুতি দিয়ে মালা বানাতাম। আমি একা-একাও পুতুল খেলে অনেক সময় কাটাতে পারতাম। আমি সেভেন-এইট পর্যন্ত পুতুলের বাক্স খাটের তলে রেখে দিয়েছিলাম। মাঝে, মাঝে আমার কাপড়ের পুতুলগুলো দেখতে খুবই ভালো লাগত।
ছোট বেলায় আব্বা যখন মন্ডপের মধ্যে আমাদের সব চাইতে সামনের বেঞ্চে বসিয়ে রেখে, আমাদের জন্য বুট,বাদাম কিনতে যেতো। তখন আমি বিভোর হয়ে ভাবতাম, এত সুন্দর শাড়ি গুলোর একটাও যদি আমি পেতাম! তা হলে কত ভালো লাগতো। আমার ছোট বেলার বড় একটা স্বপ্ন ছিলো, প্রতিমা বিসর্জন যেদিন দেয়, সেদিন আমি আব্বার সাথে, গুলশান লেকে যাবো। যদি কোনওভাবে একটা শাড়ি ভেসে আমাদের কাছে চলে আসে, আর আমি সেই শাড়িটা নিয়ে আসবো। আমার পুতুলদের কত সুন্দর শাড়ি বানিয়ে দিতে পারবো। আমার সব চাইতে কষ্টের বিষয় ছিল এত সুন্দর শাড়ি গুলো ভাসিয়ে দেওয়া নিয়ে। আর আমার চোখেও পানি চলে আসতো কেন এত সুন্দর প্রতিমাগুলো পানি ডুবিয়ে দেওয়া হয়। যদিও বেশিক্ষণ এই কষ্ট থাকতো না। কারণ আমি জানি আবার সামনের বছর দেবী দুর্গা আবার আসবেন। আমার হবে দুর্গা পুজা আবার আমরা পুজা দেখতে যাবো আব্বার হাত ধরে।আব্বা মুরলী, নিমকি, চকোলেট, লাঠি আইসক্রিম কিনে দিবে সাথে বট, বাদাম।
ঠিক তেমনি, এখন আমরাও আমাদের একমাত্র কন্যা অমরাবতীকে নিয়ে দুর্গাপূজা দেখতে যাই।তবে আমরা বেশির ভাগই ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যাই। আর সেখানে গিয়ে আমি একদম আমার ছেলে বেলায় চলে যাই। আমি কত কিছু যে কিনি সেখানকার মেলা থেকে। চুড়ি, টিপ, পলা,মালা, ছোট ছোট প্রদীপ। নিমকি,মুরলী, বাদাম,চিপস। আমি সব সময়ই চেষ্টা করি আমার মেয়েকে বোঝাতে আমাদের দেশটা সব ধর্মের মানুষের সহ অবস্থানের দেশ। মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখতে হবে, তারপর ধর্ম। সবার নিজস্ব ধর্মীয় আচার স্বাধীনভাবে পালন করার অধিকার আছে সবার। যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। ধর্ম আর সামাজিকতা দুটো ভিন্ন বিষয়।
প্রতিবেদক – সুরাইয়া শারমিন
Discussion about this post