প্রতিটি আনন্দে, আবেগঘন মুহূর্তে বাঙালি মন গেয়ে ওঠে ’শোনো গো দখিন হাওয়া’ কিংবা ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে’। ’আমি টাগডুম টাগডুম বাজাই’ বা ‘বিরহ বড়ো ভাল লাগে’ প্রভৃতি গানগুলিও সমান জনপ্রিয়। গানের নামগুলি শুনেই মনে পড়বে শচীনকর্তার নাম। তাঁর সেই লাস্যময়, আবেগময় নিবেদন। কিন্তু এই গানগুলির গীতিকারের নাম সেই একই উৎসাহে কাউকে নিতে দেখা যায়না। আজকের ইন্টারনেটের যুগেও অনায়াসে গানগুলিকে ‘এস ডি বর্মণের গান’ বলে চালিয়ে দেওয়া সহজ কাজ, কেউ সামান্য সন্দেহ প্রকাশও করবেননা। কারণ, গানে সুর দেওয়া তো দূরের কথা, বরাবর পুরুষ সুরকারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন মহিলা সঙ্গীতশিল্পীরা। তবু স্টিরিওটাইপ ভেঙ্গেছেন এই মহিলারাই। উপরের গানগুলির কথা শচীন দেববর্মণের স্ত্রী, রাহুল দেববর্মণের মা মীরা দেববর্মণের।
মীরাদেবী জন্মেছিলেন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্থানের কুমিল্লা জেলায়। দাদু-দিদিমার বাড়িতে তাঁর বড়ো হওয়া। কলকাতায় বসবাস করার সময় শুরু হয় পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতের তালিম। সংগীতাচার্য সুরেন্দ্রনাথ দেবের কাছে কীর্তন এবং ঠুমরি শিক্ষা লাভ করেন তিনি। অনাদি দস্তিদারের কাছে শেখেন রবীন্দ্রসংগীত। শান্তিনিকেতনে অমিতা সেনের কাছে করেছিলেন নৃত্যচর্চা। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও তালিম নিয়েছেন সঙ্গীতের। এলাহাবাদ নিখিল ভারত সঙ্গীত সম্মেলনে শচীন দেববর্মনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও বিবাহ।
পুত্রের জন্মের পরে তাঁরা চলে যান মুম্বইতে। ১৯৪৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও অডিশনে উত্তীর্ণ হয়ে রেডিওতে গজল-ঠুমরী পরিবেশন করতেন মীরাদেবি। স্বামীর সঙ্গে রেকর্ড করেছেন বহু গান। এ সময় সংগীত পরিচালক হিসেবেও তাঁর নতুন যাত্রা শুরু হয়। বিভিন্ন হিন্দি ছবিতে সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। বলা বাহুল্য সেই সময় বাংলা গানের জগতে মহিলা সঙ্গীত পরিচালক ছিলনা বললেই চলে। সেই তিরিশের দশকে মহিলা সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ভারতীয় সিনেমা পেয়েছিল জদ্দান বাঈ ও সরস্বতীদেবী কে। পরবর্তীকালে নীতা সেন, বাঁশরী লাহিড়ী প্রমুখের মত বাংলা ছবির মহিলা সুরকারদের কথা কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ জানে না।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শেষে মীরা দেববর্মণ গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। ফেরার পথে দেখেছিলেন এক সদ্য বিবাহিতা কিশোরী তার ভাইকে দেখার জন্য কাঁদছে। বাড়ি ফিরেই নাকি মীরাদে্বী লিখেছিলেন ‘কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া আমার ভাই ধনরে কইও নাইয়র নিত আইয়া’ গানটি। শেষজীবনে পুত্র ও স্বামীর মৃত্যু শোক তাঁকে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় পৌঁছে দিয়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কথা। স্বামীর গানের রেকর্ড শুনলে নড়ে চড়ে বসতেন। মুম্বইয়ের একটি বৃদ্ধাশ্রমে তাঁর মৃত্যু হয় ২০০৭ সালে। সারাজীবন ধরে অসামান্য প্রতিভার প্রকাশের পরেও সামান্য একটিও পুরস্কার জোটেনি তাঁর। স্বামী-পুত্রের জনপ্রিয়তার নিচে এখনও চাপা পড়ে আছেন গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীতবোদ্ধা মীরা দেববর্মণ।
তথ্য ও চিত্র ঋণ – বঙ্গভিটা
Discussion about this post