পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগর, গুপ্তিপাড়া ও নদীয়ার কৃষ্ণনগর। জগদ্ধাত্রী উৎসব বলতে এই ক’টি জায়গার নামই বারবার উঠে আসে। কিন্তু এর বাইরেও এমন কিছু এলাকা রয়েছে, যেখানে জাঁকজমকে পুজো হয় দেবীর। তেমনই একটি জায়গা হল পশ্চিম মেদিনীপুরের মীরবাজার। বহু বছর ধরেই এখানে চলে আসছে ঘোষবাড়ির ঐতিহ্যবাহী জগদ্ধাত্রী পুজো। আর এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে প্রায় ২৮০ বছরের পুরোনো ইতিহাস। চলুন ছোট্ট শহরের এই জাগ্রত দেবীর পুজোর এমন কিছু অলৌকিক ইতিহাস জানি।
সেবছর হুগলীতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। একরকম মৃত্যুমিছিল শুরু হয় ওখানে। তাই হুগলীর গোবিন্দপুর গ্রামের ভিটে ছেড়ে পরিবার সমেত দ্বারিকানাথ ঘোষ চলে আসেন এই মেদিনীপুর শহরে। পশ্চিম মেদিনীপুরের মীরবাজারে দুটি পুকুরসহ বিশাল জমি কিনে বানালেন নিজস্ব বাড়ি। কিন্তু ভুলতে পারলেন না কুলদেবী সিংহবাহিনীকে। তাই শুরু করলেন জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন। পাঁচ পুরুষ ধরে তাঁর বংশধররা এই পুজোর আয়োজন করে আসছেন একইভাবে। নবমী তিথিতেই এখানে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর ৩ টি পুজোই হয়ে থাকে। বলিই হল এখানের পুজোর মূল আকর্ষণ। সপ্তমীতে চালকুমড়ো বলি দিয়ে শুরু হয় পুজো। তারপর অষ্টমীতে ঢাক ঢোল সহযোগে ছাগমুন্ড বলি পড়ে। নবমীতে আবার চালকুমড়ো ও আখ বলি দিয়ে পুজোর শেষ। এখানের দেবী সর্বালঙ্কারে ভূষিতা। মুকুট, টিয়ারা, টিপ থেকে পায়ের তোড়া, অস্ত্র, পুজোর ঘট, ঘটের ডাব, বেলপাতা সবটাই সোনা বা রূপো ধাতুতে গড়ানো।
কথিত রয়েছে, পুজো চলাকালীন মায়ের হাত, পা, কোল কিংবা ঘট থেকে ফুল মাটিতে পড়বেই। ফুল না পড়া অবধি বলির কাজ শুরু করাই যাবে না। এমনকি দশমীতে নিরঞ্জনের সময়ও মায়ের এই আশীর্বাদী ফুল পড়া বাঞ্ছনীয়। এই পুজোর নৈবেদ্যতে বাড়ির বিবাহিত মেয়ে-বৌ বিশেষ এক ছানার সন্দেশ বানান। এছাড়া পুজোর জন্য ধূপও বাড়িতে মশলা বেটে, রোদে শুকিয়ে বানানো হয়। অষ্টমীতে কুমারী মায়ের পা ধুইয়ে হয় কুমারী পুজো। নবমীতে হোম যঞ্জ। দশমীতে বাড়ির বড়রা বরণ করেন মাকে। বিবাহিত মেয়ে-বৌ কনকাঞ্জলি দেয়। তারপর সিঁদুর আলতা পরিয়ে, বেহারার কাঁধে চেপে মা যান বিসর্জনে ।
স্থানীয়দের বিশ্বাস এই দেবী খুবই জাগ্রত। শোনা যায়, একবার বিসর্জনের আগে একটি অঘটন ঘটে। কোনওভাবেই মাকে নাকি তাঁর আসন থেকে সরানো যাচ্ছিলো না। সবাই ভীত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। পরে নজরে আসে অলঙ্কার খোলার সময় ভুলবশত মায়ের গলার সাপটি খোলা হয়ে যায়। সাপটি আবার যথাস্থানে রাখতেই মাকে সরানো সম্ভব হয়েছিল। তাই মেদিনীপুর শহরে বিশেষ খ্যাতি রয়েছে এই ঘোষবাড়ির পুজো। বহু মানুষ ভিড় জমায় পুজো চলাকালীন। যদিও চলতি বছরে মহামারির জেরে সেই সংখ্যা কিছু কমেছে। যথেষ্ট সাবধানতায় শেষ হল এ বছরের ঘোষবাড়ির পুজো।
Discussion about this post