এক পড়ন্ত চৈত্রের মরা ব্যাঙের মত অদ্ভুত বিকেলে সন্ধ্যাতারাটা তখন সবে উঠব উঠব করছে দূরের পাহাড়টার কোল ঘেঁষে! সমস্ত আকাশটা সেই একলা তারার মোলায়েম আলো মেখেছে গোটা শরীর জুড়ে! লাল মেটে পথের দুদিক জুড়ে মহুয়া আর সেগুনের জঙ্গল যেন আগামী সেই অশরীরী রাত্রিরই অপেক্ষায় বসে….কত জন্মের সেই অপেক্ষা….কত শতাব্দী প্রাচীন সেই দীর্ঘ নিশ্বাস! লাপরা,কঙ্কা আর হেসালঙ এই তিনটে ছোট্ট গ্রাম নিয়ে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। আমার মনের আমার প্রাণের ম্যাকলাস্কিগঞ্জ! ওই পাহাড়ি রাস্তা, ওই জংলী টাঁড়, ওই লালমাটি…ওই পিটিসের ঝোপে নেশা আছে! পাগল করার নেশা! বন্য মহুয়ার টান ওই সেগুনের বনে… আর সেই হায়না ডাকা একলা শালিকের মত রাতে যদি বৃষ্টি নামে? যদি শুকনো খাত গুলোর সাথে সাথে কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়ে যায় সমস্ত অনুভূতি? ঢেউ এর পর ঢেউয়ে পায়ের তলা থেকে বালি সরে গেলে যেমন লাগে,ঠিক তেমন…. কোথা থেকে আসে এত হারানোর ভয়? কোথা থেকেই বা আসে এত দুঃখ বিলাস? আচ্ছা,বুকজোড়া হুহু ছাড়া কি আর কিছুই দাঁড়াতে পারে সেই স্রোতের সামনে? এমন সব রাতের ভোর হতে নেই যে।
কী এমন আছে এই ছোট্ট একফালি জংলী জায়গায়? নেশা? নাকি বুকফাটা হাহাকার? নাকি এক বসন্ত প্রেম? নাকি সেগুনের বনে মাথাকুটে মরা হাওয়াটার মতই হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রনা? আচ্ছা সে যন্ত্রনাতেও কি সত্যিই নেশা নেই? সে আগুন ধরায় না শরীর জুড়ে? পুড়িয়ে দিয়ে যায়না প্রতিটা ইঞ্চি? বন্য প্রেম এসে ঝাঁকিয়ে বসেনা বিছানার পাশটাতে?
“এই জায়গাটাতে সকাল হয় না,সকাল আসে।” কত শত পাগলা ঝোরা,কত সর্পিল নদী, কত ঝরা পাতা মাড়িয়ে সকাল আসে! সোনালী রোদের চাদর পরে সেই সকালকে বুকে টেনে নেয় ম্যাকলাস্কি….প্রত্যেকবার! এখানে অসুন্দর বলে কিছু নেই, এদিকে ওদিকে পাহাড়ি ঢালে ওঁরাওদের গ্রাম! লাল লাল টালির ছাদওয়ালা ছোট ছোট ঘর! তারা রাস্তার দুদিকে সর্ষে আর মৌরি চাষ করেছে! দূর থেকে মনে হয় নীচের উঁচু নিচু জমি গুলোতে কেমন হলদে সাদা মাদুর বিছানো! বাড়ি গুলোর উঠোনে তাদের পোষা শুয়োর আর গরু চড়ছে! এসবের সাথে কখন যেন একাকার হয়ে যায় বন্য টিয়ার হুটোপুটি আর তিতিরের কান্না! কনকনে একটা দমকা হাওয়া এসে পিটিসের শুকনো ঝোপগুলোকে দুলিয়ে দিয়ে যায় সাইরেন ছাড়াই! এখানে কেউ আসে না নীলাঞ্জনা, এখানে কেউ ঝাড়ে না বৃষ্টি পালক! হাজার বছর পথ হাঁটার পর ম্যাকলাস্কিগঞ্জ সামনে এসে দাঁড়ায় তার ধূসর বিষণ্ণ গোধূলি নিয়ে! তবু সেই বিকেলেও কারিপাতার ঝোপের তলায় বসে কত শত না বলা গল্প,কত ইতিহাস বুকে নিয়ে বিরহী ঘুঘুরা গায় ‘ঘরে ফেরার গান’।
কীভাবে যাবেন ম্যাকলাস্কিগঞ্জ? ট্রেনে হাওড়া থেকে রাঁচি নেমে সেখান থেকে গাড়িতে ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। এই বসন্তে কিন্তু ঘুরে আসতেই পারেন একবার।
Discussion about this post