“আমি সর্বত্র যেতে চেয়েছিলাম এবং সব কিছু দেখতে চেয়েছিলাম এবং আমি আমার পথ লিখতে চেয়েছিলাম।” কথাগুলি বলেছেন মার্থা গেলহর্ন, শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি বরং পালন করেছেন অক্ষরে অক্ষরে। তিনি প্রথম মহিলা যুদ্ধকালীন সাংবাদিক ও একজন মার্কিন লেখিকা। বিশ শতকের প্রথমভাগে একজন মহিলা হিসেবে মার্থা তথাকথিত স্ত্রী, মা, কন্যা ইত্যাদি পরিচয় থেকে বেরিয়ে বাইরের জগতে পুরুষের রাজত্বে নিজের পথ তৈরি করেছেন সম্পূর্ণ নিজেই। সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের স্ত্রী হিসেবে তিনি শুধু পরিচিত হয়ে থাকেননি। সেই সঙ্কীর্ণতার অনেক বাইরে তাঁর ব্যক্তিত্ব। বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা দিবসের দিন তাই ফিরে দেখা এই সাহসী মহিলার জীবনকে।
তাহলে জানতে ইচ্ছে করে মার্থার ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনে স্বাধীনতা ঠিক কতখানি ছিল? তিনি তার ৬০ বছরের কর্মজীবনে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি যুদ্ধের প্রতিবেদন করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে যুদ্ধকালীন সংবাদদাতারা যুদ্ধের রিপোর্ট করার জন্য সামনের সারিতে ছুটে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে মহিলা সংখ্যা ছিল না বললেই চলে। এই সময়েই অন্যতম সেরা যুদ্ধ প্রতিবেদক হিসেবে উঠে এলেন মার্থা গেলহর্ন। অথচ এই মার্থাকেই স্বামী হেমিংওয়ের কাছে প্রশ্ন শুনতে হয়েছিল যে, “তুমি কোনটা হবে? যুদ্ধের ডানপিটে সাংবাদিক, নাকি বিছানায় আমার স্ত্রী?”
মার্থা গেলহর্নের জন্ম ১৯০৮ সালে সেন্ট লুইস, মিসৌরিতে। বাবা জর্জ পেশায় শিক্ষক এবং মা এডনা সামাজিক সংগঠক ও নারীর ভোটাধিকারের সমর্থক। মা সম্পর্কে মার্থা বারবার বলেছেন, ”The true north of my life.” সম্ভবত মায়ের কারণেই মুক্ত চিন্তা ও মুক্ত জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন তিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্যারিসে ইউনাইটেড প্রেসে তিনি প্রথম চাকরি করেন। সাংবাদিকতার আকাঙ্খা ও নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। প্রেস ছেড়ে তিনি ইউরোপ ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন, বিভিন্ন সংবাদপত্রের জন্য লেখালেখি শুরু করেন। জনপ্রিয় ফ্যাশন পত্রিকার জন্য কভারও করেন।
পরবর্তীকালে মার্থা আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং পানামা আক্রমণ সহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রায় প্রতিটি যুদ্ধ এবং সামরিক সংঘাত কভার করেছেন। গেলহর্নের লেখা ছিল তাড়নামূলক এবং অন্তরঙ্গ। তিনি ছিলেন প্রতিটি ঘটনার একজন ব্যতিক্রমী প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁর লেখা যুদ্ধের ঘটনাগুলির মধ্যে মূলত ছিল বেনামী স্ট্রেচার বহনকারীর কথা, ক্লান্ত ট্রাক চালকের কথা, এল সালভাদরের মহিলা বন্দীদের কথা, ভিয়েতনামের অসহায় মায়েদের কথা। তিনি তাঁর সারাজীবনের কাজ দিয়ে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন কীভাবে যুদ্ধের ধ্বংসলীলা জীবনের সমস্ত অংশকে প্রভাবিত করতে পারে। তিনি নিজে বলেছেন, “আমি যেখানেই যুদ্ধের আভাস পেয়েছি, তখনি তাকে অনুসরণ করেছি।”
এই অনুসরণের পথে বাধা বিপত্তি তাঁর পিছু ছাড়েনি। বাইরে বেরতে না দেওয়ার অছিলায় স্বামী হেমিংওয়ে, তাঁর স্ত্রীর পরিচয়পত্র পর্যন্ত চুরি করেছিলেন, কিন্তু মার্থাকে অন্দরমহলের নিরাপদ আশ্রয়ে বেঁধে রাখা যায়নি। যেমন বেঁধে রাখা যায়নি ৮৯ বছর বয়সের মার্থাকেও। ১৯৯৮ সালে মারণরোগে আক্রান্ত এবং প্রায় দৃষ্টিশক্তি খোয়াতে বসা মার্থা আত্মহত্যা করলেন সায়ানাইডের বড়ি খেয়ে। আজ তাই সাংবাদিকতার জগতের এই বিশেষ দিনটিতে সাংবাদিকতার প্রতি দৃঢ় মনোভাব, যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের গল্প বলার প্রতিশ্রুতি, অবিশ্বাস্য শক্তি এবং উদ্যমকে মনে করে সেই অসীম সাহসী সাংবাদিককে কুর্ণিশ। যিনি দৃঢ়কন্ঠে বলে গেছেন, “I never really found my own private disorderly place in the world except in the general chaos of war.”
Discussion about this post