ছেলেবেলায় আমাদের প্রত্যেকেরই রঙচঙে জিনিসের প্রতি একটা অদম্য আকর্ষণ থাকে। আর সেটা যদি খাওয়ার জিনিস হয় তাহলে তো কথাই নেই। রঙিন আইসক্রিম থেকে শুরু নানা আকারের রঙ-বেরঙের লজেন্স, কী ছিল না আমাদের চাহিদার তালিকায়। বড়রা যতোই সেসব খেতে বারণ করতেন ততোই যেন খাওয়ার ইচ্ছেটা বেড়েই যেত। না চাইতেও জল গড়িয়ে আসত জিভের ডগায়। সুযোগ পেলেই সেসব জিনিস মুখে পুরে ফেলতাম। আমাদের ছোটবেলায় এরকমই একটি জনপ্রিয় লজেন্স ছিল ম্যাঙ্গো বাইট। আম খেতে কে না ভালবাসে! আর সেটা যদি লজেন্সের স্বাদে আর মোড়কে পাওয়া যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা! মাত্র পঞ্চাশ পয়সা দিলেই হাতের মুঠোয় পেতাম তাকে, একরকম চাঁদ হাতে পাওয়াই বলা চলে। সেটাকেই মুখে পুরে নানা স্বপ্নের জাল বুনতাম সেই শৈশবে।
এখন যেমন ইচ্ছে হলেই পছন্দসই লজেন্স কিনে যখন তখন খেতে পারি, তখন কিন্তু ব্যাপারটা এতটা সহজ ছিল না। ছোট্ট ছিলাম তাই হাতে পয়সাও থাকত না যে যখন খুশি লজেন্স কিনে মুখে পুরবো। আবার বাড়িতে লজেন্স কেনার কথা বললেই চোখ পাকিয়ে দাঁতে পোকা হওয়ার ভয় দেখানো হত মাঝেমধ্যেই। অগত্যা অপেক্ষা করতাম কবে বিকেলে বাবা-কাকার সঙ্গে একসাথে বেড়াতে যাওয়া হবে কিংবা বাড়িতে কোনো নতুন অতিথি আসবেন। তবেই তো তাঁদের কাছে লজেন্সের আব্দার করতে পারব। তবে সবসময় যে পেতাম তাও নয়, তাই টুকটাক পয়সা হাতে এলেই সেটাকে জমিয়ে রাখতাম আর লজেন্স কেনার মত জমে গেলেই ছুটতাম পাড়ার মুদির দোকানে, মুঠো বন্দী করতাম সেই অমূল্য রতন।
আমাদের পাড়ায় স্বাধীনতা দিবসের দিন পতাকা উত্তোলন এবং কুচকাওয়াজের মত কিছু অনুষ্ঠান হত। তবে আমাদের মত কচি-কাঁচাদের জন্য ওই দিনটির আকর্ষণ ছিল একটু অন্যরকম। সেখানে প্রতিবছর অনুষ্ঠানের শেষে খুদেদের হাতে মেরী বিস্কুট দেওয়া হতো, সঙ্গে দুটো করে ম্যাঙ্গো বাইট লজেন্স! তাই ছোট্টবেলায় ভোর ভোর উঠে ছুটতাম মাঠে আর অপেক্ষা করতাম কখন হাতে পাব সেই লজেন্স।
এভাবেই আরেকবার নিজের বহু কাঙ্খিত লজেন্স অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার কষ্ট এবং তার সাথে অদ্ভুত রকমের এক আনন্দও মিশে আসে এই ছেলেবেলার নস্টালজিয়ায়। একবার বাড়িতে বাবার এক বন্ধু দেখা করতে এলেন। আমার জন্য নিয়ে এলেন এক বাক্স ম্যাঙ্গো বাইট লজেন্স। আমি যেন তখন প্রায় সাত রাজার ধন হাতে পেয়ে গেছি, এতটাই খুশিতে ডগমগ করছি। সেসময় আমাদের বাড়িতে ঘর-কন্নার কাজ সামলাতেন এক পিসি। তার মেয়েও প্রায় আমারই বয়সী। সে তখন আমাদের বাড়িতে এসেছিল তার মায়ের সাথে। আমার হাতে সেই লজেন্স দেখে তার মুখটাও যেন কেমন হয়ে গেল। বেশ বুঝতে পারছিলাম সেই লজেন্সের আকর্ষণ ওর কাছেও কিছুমাত্র কম নয়। হঠাৎ কি মনে হতে লজেন্সের বাক্সটি তুলে দিলাম তার হাতে। অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল সে। আর একদিকে লজেন্স হারানোর কষ্ট আর অন্যদিকে অন্য একজনকে খুশি করার আনন্দে আমার চোখেও তখন জল চিকচিক করছে।
এভাবেই আমাদের শৈশবের নানা গল্প-উপন্যাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভালো লাগার জায়গা দখল করে রয়েছে হলুদ-সবুজ মোড়কে ঢাকা ম্যাঙ্গো বাইট। আজকাল বাজারে-দোকানে এই ম্যাঙ্গো-বাইট প্রায় বিলুপ্ত। অন্যান্য জৌলুসপূর্ণ লজেন্স সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে সেখানে। টিভিতে নানা ব্র্যান্ডের লজেন্সের বিজ্ঞাপনের ভিড়েই সেই হলুদ-সবুজে মোড়া লজেন্সের মোড়কটিকে খুঁজে চলি আজও। এসবের মাঝে হঠাৎ করেও যদি একবার দেখে ফেলি ছোটবেলার সেই নস্ট্যালজিয়াকে, আজও বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। মনখারাপ ঘিরে ধরে নিমেষেই। সেই মুহূর্তেই ফ্ল্যাশব্যাকে যেন দেখতে পাই ফেলে আসা শৈশবকে, ভালো লাগার মুহূর্তগুলোকে।
Discussion about this post