রাজার শহর কোচবিহার। তিস্তা-তোর্সা-জলঢাকা সুন্দরীদের যে ঠিকানায় বেনামী পত্র পৌঁছেছে কত! সেই শহরে রাসমেলা, যাকে ছাড়া উত্তরবঙ্গের পরিচয়পত্র অসম্পূর্ণ। এখানে শীতের আমেজ যেন সাথে নিয়ে আসে একমুঠো খুশি, ‘রাসমেলা’। উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম মেলা। স্কুল জীবনে বাংলা রচনায় মেলাকে নিয়ে লেখা কতগুলো মুখস্থ শব্দগুচ্ছে নয়, এই মেলার ব্যাপ্তি বিশাল। কোচবিহারের ইতিহাস-ঈশ্বর-বিশ্বাস-সংস্কৃতি সবের সংমিশ্রণ, তবে তৈরী হয় ‘রাসমেলা’র সংজ্ঞা।
তবে এই রাসমেলার সূচনা কোচ রাজা হরেন্দ্রনারায়ণের শাসনকালে। ১৮১২ সালে রাজা ভেটাগুড়িতে নব নির্মিত প্রাসাদে প্রবেশ করেন। সেই বছরই প্রথম রাসমেলার আয়োজন। তারপর ১৮৯০ সাল, রাজবাড়ির মদনমোহন মন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ হয়। সেবছর থেকেই রাসমেলার স্থান সরে আসে মন্দির লাগোয়া এলাকায়। ১৯১৭ সালে এই মেলার স্থান পুনরায় স্থানান্তরিত হয় ‘প্যারেড গ্রাউন্ডে’, যা বর্তমানে রাসমেলার মাঠ নামেই পরিচিত।
কোচরাজারা হিন্দু হলেও রাসচক্রে বৌদ্ধ ধর্মের ছোঁয়াও বর্তমান। বৌদ্ধ ধর্মে চক্রের আদলে প্রায় ২২ ফুট উঁচু এবং ৪-৫ ফুট ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট চোঙাকৃতি বাঁশের তৈরী কাঠামোর উপর রাসচক্র তৈরী করা হয়। সূক্ষ্ম কারুকার্যে রাসচক্রকে ফুটিয়ে তোলেন আলতাফ মিঞা। এই কাজ তাঁদের পরিবারই বংশ পরম্পরায় করে আসছেন। লক্ষ্মী পুজোর দিন শুরু হয়ে যায় রাসচক্র নির্মাণ এই কাজ।
কোচবিহারের রাসমেলা , মেলার প্রকৃত সংজ্ঞার উদাহরণ। গরম জিলিপির গন্ধ, মানুষের ভিড় আর রকমারি দোকানের আসর। উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম মেলার তকমাটা এমনি এমনি নয়। পাশ্ববর্তী জেলা-রাজ্য থেকে প্রতিবেশী দেশ, এই মেলায় সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। জেলার প্রত্যেকে যেন এই মেলার জন্য এক বছরের অপেক্ষা করে থাকে। শুধু সার্কাস কিংবা জলসার আসর নয় এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ হল বিশালাকার পুতনা রাক্ষসীর মূর্তি। যাকে ছাড়া রাসমেলা অসম্পূর্ণ তার হল জিলিপি। জগৎখ্যাত ভেটাগুড়ির জিলিপির অগুন্তি ভক্ত সংখ্যা।
এই রাসমেলার আয়োজন করে আসছে কোচবিহার পৌরসভা। জেলাশাসক রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। এবং লক্ষাধিক দর্শনার্থীর ভিড় সামলাতে কড়া নিরাপত্তায় মুড়িয়ে ফেলা হয় সমগ্র মেলা চত্বর। তবে এ বছর যাতে কো-১৯ এর সমস্ত বিধিনিষেধ মেনে চলা হয় সেই বিষয়ে কড়া নজরদারি দেওয়া হয়েছে। কোভিডের কারণে ভিড় এড়ানোর ব্যবস্থাও নিয়েছে প্রশাসন।
Discussion about this post