ধর্মান্তরিত হওয়ার পরপরই চিরকাল ভোগ বিলাসের মাঝে বড় হওয়া মাইকেল মধুসূদন দত্ত কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হলেন। জীবিকার জন্য তিনি ‘মাদ্রাজ মেইল এ্যান্ড ফিমেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম অ্যান্ড বয়েজ ফ্রী ডে’ তে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। যেসব ইউরোপিয়ান বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যথেষ্ঠ সঞ্চয় না রেখে অপ্রাপ্ত সন্তান রেখে মারা যেত তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য এটি স্থাপিত হয়। দেশীয় ভাষায় যাকে বলে অনাথ আশ্রম ৷ তাঁর বেতন ছিলো মাত্র ৪৬ টাকা ৷ এই প্রতিষ্ঠানেরই অনাথ ছাত্রী রেবেকা ম্যাকটিভিসের সঙ্গে পরিচয়ের পর তাঁর প্রেমে পড়তে রোম্যান্টিক মাইকেলের দেরি হয়নি। কবি রেবেকাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর সংসারের চাপে কবির বাড়ছিল অর্থকষ্ট। যদিও আর্থিক থাকলেও মাইকেল-রেবেকার ভালোবাসায় কোন অভাব ছিলো না ৷ তাদের প্রণয়ের ফসল হিসেবে জন্ম নেয় প্রথম সন্তান ব্যর্থা ব্লানশ ৷ সন্তান জন্মের পর আর্থিক অনটনে মাইকেল অস্থির হয়ে পড়েন। লেখালেখির অভ্যেস আগেই ছিলো, তাই বাড়তি আয়ের জন্য পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন৷
সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর রেবেকার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল। তাই স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের আশায় রেবেকা তাঁর জন্মস্থানে নাগপুরে স্বজনদের কাছে বেড়াতে যান। দাম্পত্য জীবনের এক বছর সাত মাসের মধ্যে এই প্রথম স্বামী-স্ত্রী একজন ওপরের থেকে দূরে অবস্থান করলেন ৷ এই সময়েই এমন এক ঘটনা ঘটে যা পরবর্তীতে তাদের দু’জনকে চিরদিনের মত দূরে সরিয়ে দেয়। ১৮৫১ সালে তাঁদের দ্বিতীয় কন্যা ফিবির জন্ম ৷ একই বছর কবির মা জাহ্নবী দেবী মারা যান ৷ জাহ্নবী দেবীর মৃত্যুর পর তাঁর পিতা রাজনারায়ন সন্তানের আশায় আরো দু’টি বিয়ে করেন ৷ ওদিকে রেবেকা তৃতীয় বারের মত গর্ভবতী হন ৷ এতে কবির অভাব তীব্রতর হতে থাকে ৷ তিনি অনাথ আশ্রম ছেড়ে মাদ্রাজ স্কুলে জয়েন করেন ৷ সহকর্মী জর্জ হোয়াইটের সঙ্গে তাঁর পূর্ব থেকেই বন্ধুত্ব ছিলো ৷ রেবেকা যখন প্রথম আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যান, তখন জর্জ হোয়াইটের স্ত্রী মারা যান ৷ স্ত্রী মারা যাবার কয়েক দিনের মধ্যে চল্লিশোর্ধ্ব জর্জ হোয়াইট ষোল বছরের এক কিশোরীকে বিয়ে করেন ৷ জর্জ হোয়াইটের প্রথম স্ত্রীর ঘরে তিন ছেলে-মেয়ে ৷ তার বড় মেয়ে অ্যামেলিয়া হেনরিয়েটা সাফাইয়ার বয়স সতেরো। বয়সের কারণে কিংবা বিমাতা-সুলভ স্বভাবের কারণে জর্জ হোয়াইটের দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে তার প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের সাথে সম্পর্কটা ভালো ছিল না।
বন্ধু সহকর্মীর সন্তানদের বিমাতার সংসারে অশান্তির ভূক্তভোগী হতে দেখে স্বাভাবিকভাবেই কবির দরদ উথলে উঠে ৷ দুঃখ কাতর হেনরিয়েটাও এই সহানুভূতি গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি ৷ এই সহানুভূতি থেকে ক্রমে দু’জনের মধ্যে প্রণয় সম্পর্ক গড়ে উঠে। এরই মাঝে রেবেকা চতুর্থ বারের জন্য মা হন। এদিকে হঠাৎ কলকাতা থেকে বন্ধু গৌরদাস তাঁর পিতার মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠান ৷ পিতার প্রতি যতই মনঃকষ্ট থাকুক, পিতা নেই; এমন সংবাদে যে কোন সন্তানই বিচলিত হয় ৷ গৌরদাস আরও জানান, তাঁর বাবার সম্পত্তি নিয়ে অন্যরা কাড়াকাড়ি করছে ৷ জাহ্নবী দেবী ছাড়া রাজনারায়নের অন্য তিন স্ত্রীর ঘরে কোন সন্তান হয়নি। কাজেই মাইকেলই ছিলেন একমাত্র উত্তরাধিকারী। সম্পত্তি দখলের আশায় তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে কেউ কেউ রটিয়ে দেন মধুসূদন মারা গিয়েছেন। কেউ রটিয়ে দেন রাজনারায়ন তাকে ত্যাজ্য করেছেন ৷ এমতাবস্থায় চিঠি পেয়ে তিনি গৌরদাসকে লেখেন, “প্রিয়তম গৌর, তুমি তো জানো কলকাতায় যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়! দারুণ খরচ সাপেক্ষ, বিশেষ করে আমার মতো হতভাগার জন্য! তবে তুমি যদি আশ্বাস দাও যে, বাবার সম্পত্তি থেকে আমার যাবার খরচ উসুল হবে, তা হলে কলকাতা, আমার পুরনো কলকাতার উদ্দেশ্যে পাল তুলতে রাজি আছি।”
গৌরদাসের চিঠি থেকে সম্পত্তির পরিমাণ এবং তা পাওয়ার ভরসা পেয়ে মাইকেল কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন ৷ ঠিক এমন সময়েই তাঁর সুখের সংসারে ঝড় ওঠে। সে ঝড় তাকে এতদূর নিয়ে যায় যে বাকি জীবন তিনি প্রিয়তমা স্ত্রী রেবেকা আর চার সন্তানের কাছে ফিরতে পারেননি ৷ সহকর্মী জর্জ হোয়াইটের মেয়ে হেনরিয়েটার প্রতি যে তাঁর যে সহমর্মিতা প্রেমে রূপ নিয়েছিলো তা জানাজানি হয়ে যায়। সমাজ, সংসার, আত্মীয়-স্বজন সব বাধাকে তুচ্ছ করে শ্বেতাঙ্গ রেবেকা নাম পরিচয়হীন, নিঃস্ব কবিকে বিয়ে করেছিলেন ৷ কবির এমন বিশ্বাসঘাতকতায় রেবেকা মানসিকভাবে মারাত্মক আহত হন ৷ তাই কবি বেশ কয়েকবার কলকাতায় আসার আহ্বান জানালেও রেবেকা তাঁর ডাকে সাড়া দেননি ৷ অভিমানী রেবেকার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কবি হেনরিয়েটাকে কলকাতায় আসার আমন্ত্রণ জানান। ১৮৫৮ সালের কোন এক সময় হেনরিয়েটাকে কলকাতায় বিয়ে করেন মধুসূদন দত্ত। কবি পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধার করেন, লেখক হিসেবে তাঁর আসনও মোটামুটি পাকাপোক্ত হয়। কবি ছাড়া কেউ রেবেকা এবং তার চার সন্তানের ব্যাপারে জানতেন না। কাজেই এভাবেই বিস্মৃতির অতলে চলে যায় এই বিশ্বাসঘাতকতার অধ্যায়।
তথ্য সূত্রঃ বাংলা পিডিয়া
Discussion about this post