সময়টা বিংশ শতকের প্রথম দিক। ১৫ বছরের একটি ছোট ছেলে ও তার বাবার হাত ধরে তৈরী হয় একটি ছোট ক্যান্টিন। শত ঝড় ঝাপটা পার করে আজ সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম আকর্ষণ। সকলের কাছের বিখ্যাত ‘মধুর রেস্তোরাঁ’ নামে। এই রেস্তোরাঁর সাথে জড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস ও আত্মবলিদানের কাহিনী।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্যবসা প্রসারের দায়িত্ব পড়ে নকরী চন্দ্রের পুত্র আদিত্য চন্দ্রের উপর। নকরীচন্দ্র ছিলেন বিক্রমপুরের জমিদারদের ব্যাবসায়িক সঙ্গী। নকরীচন্দ্রের মৃত্যুর পর আদিত্য চন্দ্র ব্রিটিশ পুলিশের কাছ থেকে ৩০ টাকার বিনিময়ে দুটি ছনের ঘর ক্রয় করে। এরপর দুটির মধ্যে একটিতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৩৪-৩৫ সালে সেখানেই আদিত্য চন্দ্র ও তার ছেলে মধুসূদন খাবারের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৩৯ সালে পিতার মৃত্যু পর, ব্যবসার হাল ধরেন মধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের পাশে মধুদার দায়িত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যান্টিন।
সময়ের সাথে ধীরে ধীরে ‘মধুর রেস্তোরাঁ’ হয়ে ওঠে রাজনীতির পাঠশালা। যা ছিল রাজনীতির হাতেখড়ি শেখার জন্য এক উত্তম স্থান। দেশভাগের পর ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন সহ বহু মিটিং হয়েছে এই ক্যান্টিনে। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, “মধুর ক্যান্টিনের তিনটে বড় টেবিল অলিখিতভাবেই ঘোষিত ছিল তৎকালীন বিচক্ষণ ছাত্র নেতাদের জন্য। বিভিন্ন কার্যক্রমের সকল পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি এই ক্যান্টিনে বসেই নেওয়া হতো। স্বাভাবিকভাবেই এতে পাক পুলিশ বাহিনীর চোখে পড়ে যান মধু।
দিনটা ছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। পাক সেনারা মধুদার বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রী, পুত্র আর পুত্রবধূকে হত্যা করে ও মধুদাকে তুলে নিয়ে যায় জগন্নাথ হলের মাঠে। সেখানে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হয় তাঁকে। গুলিতে লুটিয়ে পড়ে তাঁর দেহ। হানাদার বাহিনীরা দুমড়ে-মুচড়ে দেয় তাঁর ক্যান্টিনও। মধুদাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে নিহত সবার সাথে সেখানেই গণকবরে সমাহিত করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দাঁড়া সংস্কার করা হয় রেস্তোরাঁটি। শুরুতে এটি মধুর স্টল, মধুর টি-স্টল ইত্যাদি নামেও পরিচিত থাকলেও বাংলা ১৩৭৯ সালের ২০ বৈশাখ ডাকসুর উদ্যোগে এর নামকরণ করা হয় ‘মধুর রেস্তোরা’।
স্বাধীনতার পর থেকে মধুসূদনের দ্বিতীয় পুত্র অরুণকুমার দে মাত্র এগারো বছর বয়সে ক্যান্টিনের দায়িত্ব তুলে নেন নিজ কাঁধে। এখন অবধি কাঁধে করে নিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। মধুদার স্মরণে মধুর ক্যান্টিন প্রাঙ্গনেই নির্মিত হয় তার স্মৃতি ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটির গায়ে লেখা রয়েছে ‘আমাদের প্রিয় মধুদা’। ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল তৎকালীন উপাচার্য এমাজ উদ্দীন আহমেদ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন। মধুদা স্মৃতি সংসদ প্রকাশনী’র উদ্যোগে প্রকাশিত হয় “মধুদা: শহীদ মধু সূদন দে স্মারক গ্রন্থ” বইটি। বইটির ভূমিকায় অধ্যাপক প্রয়াত আনিসুজ্জামান লিখেছেন “একদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য মধুর ভালবাসা আর অন্যদিকে মধুর প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা। মধুর ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্বই যে ছাত্র-ছাত্রীদের ভরসার কারণ হয়ে উঠেছিল এসব কিছুই শত্রুদের বোধগম্যতায় আসে নি।”
Discussion about this post