ইতিহাসপ্রেমী মানুষের কাছে পরিচিত নাম বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের রাজকাহিনী ও স্থাপিত মন্দিরগুলি। বাঁকুড়া শহর থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রাচীন ‘ছত্রিনা নগরী’ তথা অধুনা ছাতনাও যে এক ইতিহাস বহন করে চলেছে তা লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গিয়েছে। উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে স্থাপত্যগুলির অবস্থা কোনটা জরাজীর্ণ আবার কোনওটা প্রায় আবলুপ্তির মুখে। কলকাতা থেকে যারা রেলপথে শুশুনিয়া ঘুরতে আসেন তাদের জন্য নিকটবর্তী রেল স্টেশন হল ছাতনা। এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম হল- ধনযখ, বাসুলী মায়ের মন্দির, বড়ু চণ্ডীদাসের জন্মভিটা, বীরস্তম্ভ, মাচান, ছাতনা রাজদরবার ইতাদি। এর মধ্যে বাসলি মায়ের মন্দির যুগল রক্ষণাবেক্ষণ হলেও বাকিগুলি এখনও উপক্ষিত।
ছাতনা শহরের পূর্বদিকে রয়েছে বোলপুকুর। এর দক্ষিণ-পশিম পাড়ের বিস্তীর্ণ স্থানে মাটি খুঁড়ে প্রচুর খাদ্যশস্য ও প্রাচীন মুদ্রা পাওয়া যায়। মনে করা হয়, সামন্ত রাজাদের খাদ্য ও ধন ভাণ্ডার ছিল এটি। জায়গাটি ‘ধনযখ’ নামে খ্যাত। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে এটি চাষ জমিতে পরিনত হয়েছে। এরকমই এক অসংরক্ষণের জলজ্যান্ত নমুনা হল ‘মাচান’। কামারকুলির মদনা ও ভেলা পুকুরের মাঝ বরাবর অবস্থিত এই মাচান। মদনা নামক পুকুরটির পাড়ে স্থানীয় গ্রামবাসীর ‘মহাদানা’ দেবতার বাসস্থান। সমগ্র বাঁকুড়া জেলায় ৪ টি ও পার্শ্ববর্তী পুরুলিয়া জেলায় ১ টি এরূপ টাওয়ারের খোঁজ মেলে। ১৪ কিলোমিটার ব্যাবধানে এগুলি নির্মাণ করা হয়েছিল। টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের আগে তৎকালীন সময়ের সংবাদ মাধ্যমের বার্তা আদান প্রদান করার জন্য এই ৮০-১০০ ফুট উঁচু টাওয়ারগুলি নির্মাণ করা হয়েছিল। চারটি তলা বিশিষ্ট পাতলা ইটের গাঁথনি দিয়ে তৈরি এই টাওয়ারগুলিতে লোহার সিঁড়ি ছিল।
এগুলোকে ‘সিমাফোর টাওয়ার’ বলা হলেও স্থানীয় ভাষায় ‘মাচান’ নামেই পরিচিত। মাচানগুলির ওপরে রাত্রে মশাল জ্বেলে ও দিনের বেলায় লাল পতাকা দেখিয়ে ডাকে বার্তা আদান প্রদানের সংকেত দেখান হতো। প্রাচীন এই নগরীর ইতিহাসের পাতায় নানান সম্প্রদায় রাজত্ব দেখা গিয়েছে। ক্ষত্রিয় রাজদের সাথে তৎকালীন মল্ল রাজাদের একবার যুদ্ধ বাঁধলে, সন্ধি স্বরূপ রাজদরবারে দুর্গা পুজোর সূচনা হয়ে থাকে। প্রতি বৎসর দুর্গাপূজার সময় এক রহস্যময় পুঁটুলি রাজবাড়ী থেকে দুর্গা দালানে নিয়ে আসা হয়। স্থানীয়দের মতে এই পুঁটুলির ভেতরেই রয়েছে সেই যুদ্ধের সন্ধিপত্রের খসড়া। বর্তমান রাজ উত্তরসূরির নাম লাল কালিতে একটি নতুন বস্ত্রের ওপর লিখে বস্ত্র দ্বারা পুঁটুলিটিকে ঢেকে মায়ের পদতলে রেখে পূজা শুরু করা হয়। তাই এই শীতের মরশুমে শুশুনিয়া বেড়াতে এলে ছাতনার এই হারিয়ে যাওয়ার পথে পা বাড়ানো নিদর্শনগুলি চাক্ষুষ করতেই পারেন। তার সঙ্গে অবশ্য উপরি পাওনা ছাতনার বিখ্যাত প্যাঁরার স্বাদ।
Discussion about this post