আমাদের তিলোত্তমা শহর শুধুই কর্মব্যস্ততা আর জীবনের তাগিদে ভাসমান মহানগর নয়। কলকাতা জানে পার্বণের সঙ্গে বনেদিয়ানার ঐতিহ্যকে বহন করতে। তাই তো মধ্য কলকাতার বউবাজার এলাকায় মুচিপাড়া থানার ১০ নম্বর বাবুরাম শীল লেনের নৃত্য ভবন (দত্ত পরিবার) আমাদের এবারের গন্তব্য। এই পুজো কলকাতার বনেদি বাড়ির জগদ্ধাত্রী আরাধনা গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য। দত্ত পরিবারে জগদ্ধাত্রী পুজো কবে শুরু হয়েছিল, সঠিক জানা যায় না। তবে পুজোর বয়স বহু বছর সেই বিষয়ে নেই কোন দ্বিমত। কেন না পাঁচ পুরুষ ধরে তাঁরা জগজ্জননী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করে আসছেন।
দত্ত পরিবারে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূত্রপাত করেন পরিবারের আদি পুরুষ বলাই চাঁদ দত্ত। প্রথম কয়েক বছর পুজো অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৩ নম্বর বাবুরাম শীল লেনের বাড়িতে। বলাইচাঁদ দত্তের পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র নৃত্যলাল দত্ত জগদ্ধাত্রী পুজোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি অদূরে ১০ নম্বর বাবুরাম শীল লেনে তিন খিলানের ঠাকুরদালান-সহ বিশাল অট্টালিকা তৈরি করে পুজো সেখানে স্থানান্তরিত করেন। সেও দেড় শতাধিক বছর আগের কথা। তারপর থেকেই ওই বাসভবনে জগদ্ধাত্রী পুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন সকাল থেকেই অতিথি-অভ্যাগতদের সমাগমে ‘নৃত্য ভবন’ মুখরিত হয়ে ওঠে। দত্ত পরিবারের যে সব সদস্য অন্যত্র বাস করেন, তারাও জগদ্ধাত্রী মায়ের অমোঘ আকর্ষণে ‘নৃত্য ভবন’-এ উপস্থিত হন। জগদ্ধাত্রী পুজো এদের কাছে পারিবারিক মিলনোৎসবও। এই দিনটির জন্য দত্ত পরিবার সারা বছর সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে।
ডাকের সাজে সজ্জিতা স্বর্ণালংকারে ভূষিতা নয়নাভিরাম মাতৃ মূর্তি। মায়ের শান্ত স্নিগ্ধ প্রসন্নময়ী রূপে হৃদয় বিগলিত হয়ে যায়। দেবী জগদ্ধাত্রী চতুর্ভুজা। চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম। দেবীর বাহন শ্বেতবর্ণের সিংহ। সিংহের পদতলে হস্তিমুণ্ড। দেবীর দুই পাশে দুই সহচরী—জয়া ও বিজয়া। জগদ্ধাত্রী পুজোর আগের দিন সন্ধ্যায় দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। পুজোর দিন সকালে ৭ নম্বর বাবুরাম শীল লেনস্থ ঠাকুরবাড়ি থেকে নারায়ণ, মা মঙ্গল চণ্ডী, মা লক্ষ্মী-কে ‘নৃত্য ভবন’-এ নিয়ে আসা হয়। এরপর প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও চক্ষুদান করে পুজোর অনুষ্ঠানিক সূচনা হয়।
অষ্টমী ও সন্ধিপুজোর মধ্যবর্তী সময়ে মহিলারা দু’হাতে দুটো সরা এবং মাথায় একটা মালসা নিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে বসে কাঠ-কয়লার আগুনে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে ধুনো পোড়ান। এটি সুবর্ণ বণিক সম্প্রদায়ের একটি নিজস্ব রীতি। বৈষ্ণব মতে পুজো হয় বলে বলির প্রথা নেই। অন্নভোগ হয় না। সংকল্প হয় পালাদারের নামে। পুজোর ব্যয় নির্বাহ হয় ‘জগদ্ধাত্রী মাতা’র নির্দিষ্ট বাড়ির ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত আয় থেকে।
পরদিন সকালে দশমী পুজো আর দর্পণে মায়ের চরণ দর্শনের পালা। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে মায়ের বিদায় মুহূর্ত। সবশেষে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য মা জগদ্ধাত্রীর পা ধুইয়ে দেন এবং মা’কে কানে কানে আগামী বছর আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এরপর কনকাঞ্জলি দিয়ে মা জগদ্ধাত্রীকে বিদায় জানানো হয়। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী, বাবুঘাটে জগদ্ধাত্রী প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। আগে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হতো নৌকায় করে মাঝ গঙ্গায়। বর্তমানে প্রশাসনিক অনুমতি না মেলায় বিসর্জনের সেই রীতি অনুসৃত হয় না। এই ভাবে কলকাতার বুকে কত ইতিহাসের পটে আঁকা রয়েছে নানা পুজোর ইতিহাস। বাঙালী শুধু উৎসব মুখর নয়, ঐতিহ্যকে ধারণ করে বছরের পর বছর।
Discussion about this post