শীতের ঝলমলে রোদে বসে তুলো ধোনার দৃশ্য আজ গেছে হারিয়ে। একটা সময় ছিল যখন শীতের সকালে লম্বা বাঁশের লাঠির আঘাতে নরম তুলো ফুলে উঠত, আর তার পাশেই ধনুকের মতো বেঁকে থাকা ‘ধুনুরি’ থেকে ভেসে আসত টংটং শব্দের এক অনন্য সুর। সেই সুরই ছিল গ্রাম বাংলার শীত-দুপুরের সিগনেচার টিউন। লেপ বানানোর আগে তুলো ভালো করে ধোয়া—বা ধোনা—হত এই ধুনুরির তারে। কেমন করে যেন হারিয়ে গেল সেই যন্ত্র, সঙ্গে হারিয়ে গেল এক পেশাও।
একসময় বিহার, হরিয়ানা বা উত্তরপ্রদেশের ধুনিরাও বাংলার ধুনিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলার গাঁ-গঞ্জে এসে তাঁবু খাটিয়ে কাজ করতেন। কিন্তু সেই দৃশ্য এখন ইতিহাস। ভিনরাজ্যের ধুনিদের আসা বন্ধ হয়েছে বহুদিন। শুধু রয়ে গিয়েছেন এই রাজ্যের স্থানীয় ধুনিরা। আর তাঁরাও এখন পেশা ছাড়ার সুযোগ খুঁজছেন। লাল মহম্মদ নামে এক প্রবীণ ধুনি বলেন, “ছোটবেলা থেকে এ কাজ করছি। অন্য কিছু পারি না। রোজগার নেই বললেই চলে। কিন্তু না করেও উপায় নেই। পেট তো চালাতে হবে।” সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে যেন পিছিয়ে পড়েছে তাঁদের জীবিকা, পিছিয়ে পড়েছে তাঁদের দক্ষতা।
এর প্রধান কারণ বাজারের বদল। এখন আর কেউ লেপ বানানোর বরাত দেয় না। দোকানে আধুনিক ব্ল্যাঙ্কেট এক ধাক্কায় দখল করে নিয়েছে শীতের বাজার। তোষক তৈরির অল্প কিছু কাজ মিলছে বটে, কিন্তু সেটুকুতে সংসার চলে না। তার ওপর আজ আর ধনুক-আকৃতির ঐতিহ্যবাহী ধুনুরি নেই। তুলো ধোওয়া এখন হয় ছোট আকারের থ্রেশারের মতো মেশিনে। শাহ আলম নামে এক কারিগর জানালেন, “মেশিনে এক কেজি তুলো ধুনে ৩০ টাকা পাই। হাতে কাজ করলে এর চেয়েও কম। ধুনুরি শিল্প তো হারিয়ে যাচ্ছেই।”
গ্রাম বাংলার বহু পেশার মতো ধুনুরিরাও আজ বিলুপ্তির মুখে। একসময় যাঁদের হাতের ছন্দেই তৈরি হত শীতের উষ্ণতা, সেই সুর আজ নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার ঝড়ে গ্রাম্য ঐতিহ্যের আরও এক অধ্যায় মুছে যাচ্ছে চোখের সামনে—কেউ দেখে, কেউ দেখে না; কিন্তু ইতিহাসের বুকে নিঃশব্দে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বাংলার এক সময়ের অপরিহার্য শীত-শিল্প।






































Discussion about this post