পুরাণের লতায় পাতায় জড়িয়ে নানা গল্পগাছা। সত্য মিথ্যা বিচারের আগেই তার প্রতি মনেপ্রাণে জন্মায় এক বিশ্বাস। কারণ পুরাণ যে নানা দেবদেবীদের আখ্যানে পরিপুষ্ট। কিন্তু জানেন কি ভগবান শিবের প্রিয় ফুল কি? চাঁপাফুল। এটিই মহাদেবের সবচেয়ে পছন্দের ফুল। তবুও শিব পুজোতে বহুকাল ধরেই চাঁপাফুলের ব্যবহার নিষিদ্ধ। কীভাবে শিবপুজোতে চাঁপাফুল হয়ে পড়ল ব্রাত্য জানতে নিশ্চয়ই মনটা আনচান করছে? চলুন তবে একটু পৌরাণিক গল্প ঘেঁটে দেখা যাক।
দাক্ষিণাত্যের গোকর্ণপুরে শিবলিঙ্গের পুজো হত ‘গোকর্ণেশ’ রূপে। এমনকি সেই মূর্তি দর্শনেই হত সমস্ত পাপ স্খলন। কৌতূহলের বশে ছদ্মরূপে নারদমুনি তাই এলেন একদিন দর্শনে। কিন্তু এসেই এক রহস্যময় ঘটনায় পড়লেন জড়িয়ে। মন্দিরের রাস্তার দুধারে আকন্দ আর কলকে বন পেরিয়েই দেখতে পেলেন রূপে গন্ধে অনন্য এক চাঁপাফুলের গাছ। কিন্তু সেই গাছের সামনে দাঁড়িয়ে এক ব্রাহ্মণকে দেখে অদ্ভুত লাগল নারদের। হাতে ফুলের সাঁজি দেখে নারদ জিজ্ঞেস করলেন সে কি ফুলের সংগ্রহের জন্যই দাঁড়িয়ে? ওদিকে ব্রাহ্মণ কেমন নিজেকে আড়াল করে জানায় সে ভাটভিখারি। তাই ভিক্ষার উদ্দেশ্যেই দাঁড়িয়ে। নারদ তা বিশ্বাসও করেন। মন্দির থেকে ফেরার পথে আবার নারদ সামনাসামনি হলেন ব্রাহ্মণের। এবার তার সাঁজি আবার পাতা ঢাকা। নারদ সাঁজিতে কি আছে জানতে চাইলে সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এবারেও এক কথা জানায় সাঁজিতে সামান্য ভিক্ষেই আছে। সন্দেহের পারদ উঠলেও নারদ চুপই থাকেন। কিন্তু চাঁপাগাছের সামনে পৌঁছে তিনি রীতিমতো অবাক। গাছে একটিও ফুল নেই। এবার চাঁপাগাছকেই সরাসরি প্রশ্ন করলেন কে তার ফুল তুলেছে? চাঁপাগাছটিও এড়িয়ে যায় ব্যাপারটি। অদ্ভুতুড়ে এই ঘটনাটার শেষ না দেখে ফিরতেই পারছেন না নারদ।
তিনি আবার ফিরলেন মন্দিরে। কী আশ্চর্য! শিবলিঙ্গের সামনে কেউ ১০৮ টি চাঁপাফুলেই পুজো দিয়েছে। পূজারীকে জানতে চাইলে তিনিই সবটা খুলে বলেন। তিনি জানান ও এক ভন্ড ব্রাহ্মণ। ইচ্ছে করেই সব ফুল আগে তুলে নেয় রোজ। যাতে সে ছাড়া আর কেউ চাঁপাফুলে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করতে না পারে। চাঁপাগাছটিকেও তার বশেই রেখেছে। তাই সেও ব্রাহ্মণের পাল্লায় পড়ে মিথ্যে বলে। তখনই সেখানে হাজির এক বৃদ্ধা। কাঁদতে কাঁদতে সে জানায় ওই ব্রাহ্মণ তাদের ঠকিয়েছে। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগাড় করে দেবে এই লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাদের রাজদরবারে। কিন্তু সেখানে থেকে পাওয়া যাবতীয় দানসামগ্রী ব্রাহ্মণ ওই বৃদ্ধার বাড়ি এসে লুটেপুটে নিয়ে চলে গেছে। সব শুনে নারদ গেলেন রেগে। ভগবান শিবকে জিজ্ঞেস করলেন যে এমন ধূর্ত লোকের সহায়তা কেন করছেন তিনি? উত্তরে ভগবানও জানান চাঁপা তাঁর পছন্দের ফুল। এই ফুলে পুজো করলে যে স্বয়ং মহাদেবও বশীভূত হয়ে পড়েন। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে মহাদেব তাই নারদ মুনিকেই দায়িত্ব দেন। নারদ তখন রাগে ব্রাহ্মণকে অভিশাপ দেন যে এক ঘৃণ্য রাক্ষসীর যোনিতেই জন্ম হবে তার। আর চাঁপাগাছকেও এমন মিথ্যাচারের জন্য শাপ দেন এই ফুল আর কোনোদিন মহাদেব গ্রহণ করবেন না। এরপর থেকে চাঁপাফুলে পুজো দিলেই সে হবে মহাদেবের রোষের ভাগী। সেই থেকেই বাদ পড়ল চাঁপাফুল। মর্ত্যে চিরতরে বন্ধ হল চাঁপাফুলে মহাদেবের আরাধনা।
Discussion about this post