হাওড়ার জগৎবল্লভপুর অঞ্চলে একসময় খ্যাতি লাভ করেছিল তালাচাবি শিল্প। কুটির শিল্প হিসেবে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় মানসিংহপুর গ্রামের সুশীলচন্দ্র কর ও ভীষ্মদেব মান্না আলিগড়ে গিয়ে তালা তৈরির কৌশল শিখেছিলেন। ১৯০৫ সালে গ্রামে ফিরে তাঁরা প্রথম ক্ষুদ্র উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। বাজারে চাহিদা বাড়তে থাকে। এগিয়ে আসেন অনেক উদ্যোক্তা। কয়েক বছরের মধ্যেই হাঁটাল, বড়গাছিয়া, পাঁতিহাল, সাদৎপুর, ইছাপুরসহ আশপাশের গ্রামে তালাচাবি তৈরি একটি যথাযথ কুটির শিল্পে পরিণত হয়।
হাঁটাল গ্রামের নিতাই কর, মন্মথ কর ও ব্রজকালী কর প্রতিষ্ঠা করেন শ্যামক এন্ড কোং। পাঁচকড়ি সামন্ত গড়ে তোলেন সামন্ত ব্রাদার্স। এছাড়া তৈরি হয়েছিল সাউ ব্রাদার্স, ডায়মন্ড লক, কোহিনুর লক ফ্যাক্টরি ও হাওড়া লক ইন্ডাস্ট্রিজসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান। লোহা গলানোর জন্য ঘড়া, ছাঁচ, ফাইল, হাতুড়ি, হ্যান্ড ড্রিল প্রভৃতি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে হাতে তৈরি হতো তালা। ক্যাবিনেট লক, মর্টিস লক, সিন্দুক ও আলমারির লক শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, মুম্বাই, তামিলনাড়ু, বেঙ্গালুরু, এমনকি আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতেও রপ্তানি হতো।
১৯৫৮-৫৯ সালে বড়গাছিয়ায় প্রতিষ্ঠিত সেন্ট্রাল লক ফ্যাক্টরির আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৮০-এ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর পরেই শুরু হল পতনের ইতিহাস। একে একে ক্ষুদ্র তালা কারখানাগুলি অচল হয়ে যায়। বড় সংস্থার প্রতিযোগিতা, মার্টিন ট্রেন পরিষেবা বন্ধ হওয়া, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব ও বাজার সংকট মিলিয়ে শিল্পটি হল প্রায় বিলুপ্ত। বর্তমানে ওই অঞ্চলে নাট, বল্টু, ফ্যানের যন্ত্রাংশ ও রেল ইঞ্জিনের পার্টস তৈরি হলেও তালা শিল্পের চিহ্ন নেই কোনো।
হাঁটাল গ্রামের হাওড়া লক ইন্ডাস্ট্রিজ এখনও টিমটিম করে জ্বলছে। অভিনব প্রযুক্তির মাধ্যমে আজও সাত-লিভার ডিফেন্স লক, সি.আই.ডি. লক, হ্যান্ড-কার্ফ লক তৈরি করে তারা পূর্ব ভারতের বাজারে নিজেদের উপস্থিতি বজায় রেখেছে। কেন্দ্র সরকারের সহযোগিতায় বড়গাছিয়া মেটাল ক্লাস্টার গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও জমি-সংক্রান্ত সমস্যায় প্রকল্প থমকে আছে। শিল্পপতিরা আশাবাদী, সরকারি সহায়তা ও কমন ফেসিলিটি সেন্টার গড়ে উঠলে তালাচাবি শিল্প ফের তার পুরনো গৌরব ফিরে পেতে পারে।
Discussion about this post