শান্তিনিকেতন প্রেস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৮ সালে এই ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই ছাপাখানাটির বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অপরিসীম অবদানও রয়েছে। সালটি তখন ১৯১৭, আমেরিকার নেব্রাস্কা স্টেটের লিঙ্কন শহরে অলিভার থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের বক্তৃতা দেন। এই বক্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল জাতীয়তাবাদ। লিঙ্কন শহরের বাসিন্দারা তাঁর বক্তৃতা এতটাই পছন্দ করেছিলেন যে তারা শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের জন্য রবি ঠাকুরকে একটি মুদ্রণযন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন। এই মুদ্রণযন্ত্রটির নাম ছিল ‘দ্য লিঙ্কন প্রেস’। যন্ত্রটির গায়ে ধাতুর পাতে খোদাই করা ছিল ‘প্রেজেন্টেড টু দ্য বয়েজ অব শান্তিনিকেতন’। এই লিঙ্কন প্রেস দিয়েই শান্তিনিকেতনে প্রথম স্থাপিত হয় ‘শান্তিনিকেতন প্রেস’।
তবে মেশিন পেলেও এর ব্যবহার শুরু এক বছর পর। কারণ সরকারের থেকে ছাপাখানার লাইসেন্স জোগাড় করতে অনেকটা সময় লেগেছিল। আর তাছাড়াও সে সময় শান্তিনিকেতনে ছাপার মেশিন চালানোর কাজ কেউ জানতেন না। তাই এই সময় কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে আসেন প্রখ্যাত কবি, শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়। মুদ্রণ বিদ্যায় বিদেশী ডিগ্রী ছিল তাঁর। তিনি বেশ কিছু দিন শান্তিনিকেতনে থেকে বিষ্ণু ও নিমাই নামে দুই ছাত্রকে কম্পোজ ও ছাপার যাবতীয় খুঁটিনাটি শেখান।
এরপর শেষ পর্যন্ত ১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতনের ছাতিম তলার পাশে শুরু হয় ছাপাখানার পথচলা। এই বছরই অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয় শান্তিনিকেতন প্রেসে মুদ্রিত প্রথম বই ‘গীত-পঞ্চাশিকা’। এই বইটি রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের করা স্বরলিপির সংকলন। এরপর প্রকাশিত হয় ‘অনুবাদ চর্চা’ এবং ‘সিলেক্টেড প্যাসেজ ফর ট্রান্সলেশন ফ্রম ইংলিশ টু বেঙ্গলি’ নামে একটি ইংরেজি বই। এখান থেকেই প্রকাশিত হয় বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের প্রথম বই রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’। এই প্রেস থেকে ১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি চিঠিপত্র, প্রবন্ধ, ডায়েরি, কথিকা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘সঙ্কলন’।
রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন কিছুদিন আগেই ইউনেস্কো থেকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পেয়েছে। কিন্তু বিগত পাঁচ বছর হল কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে কবিগুরুর ছাপাখানা। ফলে নষ্ট হচ্ছে রবি ঠাকুরের প্রিয় ছাপাখানার যন্ত্রাংশ। শান্তিনিকেতন হেরিটেজ তকমা পেলেও আজ বিলুপ্ত কবিগুরুর ‘লিঙ্কন প্রেস’। কেন্দ্রীয় সরকারের এই নির্দেশের জন্য ক্ষোভে ফুঁসছে শান্তিনিকেতন। এই ছাপাখানার সাথে জড়িয়ে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য এবং ইতিহাস। এই নির্দেশ শুনে বিশ্বভারতীর কর্ম সমিতির সদস্যরা বলছেন, রবীন্দ্রনাথের হাতের তৈরি এই প্রেস। অন্যান্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এটি সম্পূর্ণ আলাদা। সরকারের উচিৎ এই ছাপাখানাকে হেরিটেজ ঘোষণা করা।
Discussion about this post