“আরে ওতো মেয়ে একটা! দেখিস না মেয়েদের মত কথা বলে? ওটা আবার মানুষ নাকি! ছেলে বা মেয়ে কোনোটাই তো নয়।” অথবা “ওই দেখ! লেডিস!” রাস্তাঘাটে প্রায়সই এসব কথা শুনতে হয় ওদের। সময় বিশেষে অপমানিতও হতে হয় বৈকি! তবুও নিজেদের মতো করে, নিজেদের খেয়ালে দিনযাপন করে তারা। ভাগ করে নেয় সুখ-দুঃখ। আয়োজন করে উৎসবেরও। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে সমপ্রেমী, রূপান্তরপ্রেমী বা উভপ্রেমীদের নিয়েই। আজ এই ২০২০ সালে পা দিয়েও সমাজের চোখে তারা এখনও যেন এক ‘অদ্ভুত অচেনা জীব’! ৩৭৭ ধারা চালু হয়ে গিয়েছে, সমাজের চোখে তবুও তাদের ভালোবাসা প্রায় অপরাধই। নিজেদের যোগ্য সম্মান টুকু পাওয়ার জন্য এখনও লড়াই করে যেতে হয় ওদের।
অথচ এই বিষয়টি নিতান্তই স্বাভাবিক এক ঘটনা। ব্যতিক্রমী তো একেবারেই নয়। অতীতের বহু পৌরাণিক কথায় অর্ধ-নারীশ্বর বা শিখণ্ডীর অথবা অজন্তায় গুহা চিত্রে সমান্তরাল ভালোবাসার নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। সাহিত্যের দলিলেও এর দেখা মেলে। তা সে শেক্সপিয়ারের সনেটই হোক বা হোক ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’। চলচ্চিত্র জগতেও এই ধারণার অবাধ বিচরণ। এই পথের পথিক হলিউডের মাইকেল জ্যাকসন থেকে শুরু করে টলিউডের ঋতুপর্ণ ঘোষও। তবে তথাকথিত ‘আধুনিক’ এখনও বাঁকা চোখেই দেখে এদের। রাস্তাঘাটে তাদের উদ্দেশ্যে নানা কটু কথা বলা পাশাপাশি, হাসাহাসি থেকে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গী করা তো রয়েছেই। এমনকি হাসপাতালে ভর্তির সময়ও চরম অশান্তির সৃষ্টি হয়, পেশেন্ট ‘পুরুষ’ নাকি ‘মহিলা’ কোন ওয়ার্ডে ভর্তি হবে সেই নিয়ে।
প্রায় একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বৃহন্নলাদেরও। সমাজ যাদের হিজড়ে বলে চেনে। রাস্তাঘাটে তাদের চলাফেরা, কথা-বার্তা ‘আম-আদমি’র কাছে নাকি ইরিটেটিং। যদিও কিছু অসাধু মানুষ শুধুমাত্র টাকার লোভে রাস্তায়-পার্কে-ট্রেনে যুগলের কাছে অন্যায্য ভাবে টাকা চেয়ে বৃহন্নলাদের সম্মান ধুলোয় মেশাচ্ছেন। ইদানীং শহরের যুবসমাজ প্রান্তিক মানুষজনদের দাবী-দাওয়া নিয়ে বিশেষভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র প্রাইড ওয়াক বা রেনবো মিছিলেই আটকে থাকা নয়, এইসব শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে আড্ডা-নাটক-জমায়েতের মাধ্যমেও সমাজের প্রতি এক কটাক্ষ ছুঁড়ে দিতে উৎসাহী ‘জেন-ওয়াই’। শুধু তাই নয়, সমাজের প্রান্তিক মানুষজনদের শোধরানোর নামে তাদের উপর করা কারেক্টিভ রেপেরও তীব্র বিরোধিতা করছে আজকের যুবসমাজ।
আসলে সমকামিতা বিষয়টিকে বিজ্ঞান একটি সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখলেও এটি আসলে এক জটিল জৈব-মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। যার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোও বেশ কিছুক্ষেত্রেই দায়ী। আমাদের সমাজের এই ‘অন্যধরণ’এর মানুষগুলি সাধারণ মানুষের থেকে কোনো রকম সহানুভূতি চান না। চান না লোক দেখানো শ্রদ্ধাও। তারা শুধু চান আর পাঁচটা ‘আম আদমি’র মতো নিজেদের প্রাপ্য সম্মান আর সমান ভাবে বাঁচার অধিকারটুকুই।
Discussion about this post