১৯৭৫’য়ের ১৫ অগাস্ট, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের এক অন্ধকার দিন। বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। বাঙালি জাতির কাছে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন যিনি। ঠিক চার বছর আগে তাঁরই নেতৃত্বে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল বাংলাদেশ। চার বছর পর, শ্রাবনের এক সকালে নিজের বাসভবনেই প্রাণ হারালেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করতেন না, এমন মানুষ হয়তো সারা বাংলাদেশে চাইলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বই প্রায় স্তভিত হয়ে পড়ে। বহু মানুষ আত্মহত্যাও করেন। আসলে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতিও ছিলেন তিনি। ওপার বাংলার মানুষের স্বার্থে বহু আত্ম বলিদানও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ঠিক কেমন ছিলেন মুজিবর রহমান? নিজের পরিবারের কিছু সদস্যকে লেখা তাঁর কিছু চিঠিপত্রের মাধ্যমে মেলে তার-ই হদিশ।
বঙ্গবন্ধুর লেখা প্রথম চিঠি তাঁর বাবা লুৎফর রহমানকে। ‘৫৮তে ঢাকা জেলে বসে তিনি এই চিঠি লেখেন… আব্বা,
আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করবেন ও মাকে দিবেন। মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিল, কারণ এবার তাঁর সামনেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল। দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবে না। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামীও একবার করেছিল। আল্লা আছে, সত্যের জয় হবেই। আপনি জানেন বাসায় কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ি যেতে বলে দিতাম। কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে। আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই, এবং রাজনীতি আর করবো না। সরকার অনুমতি দিলেও আর করবো না। যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে আমি ঘুষ খেতে পারি সে দেশে কোনো কাজই করা উচিত না। এ দেশে ত্যাগ ও সাধনার কোন দামই নাই। যদি কোন দিন জেল হতে বের হতে পারি তবে কোন কিছু একটা করে ছেলেমেয়ে ও আপনাদের নিয়ে ভালভাবে সংসার করব। নিজেও কষ্ট করেছি, আপনাদেরও দিয়েছি। বাড়ির সকলকে আমার ছালাম দিবেন। দোয়া করতে বলবেন। আপনার ও মায়ের শরীরের প্রতি যতœ নিবেন। চিন্তা করে মন খারাপ করবেন না। মাকে কাঁদতে নিষেধ করবেন। আমি ভালো আছি। আপনার স্নেহের, মুজিব গোপালগঞ্জের বাসাটা ভাড়া দিয়া দেবেন। বাসার আর দরকার হবে না। মুজিব।
দ্বিতীয় চিঠি ঢাকা জেলে বসেই ‘৫৯তে নিজের স্ত্রী রেনুকে লেখা… রেনু, আমার ভালবাসা নিও। ঈদের পরে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আস নাই। কারণ তুমি ঈদ করো নাই। ছেলেমেয়েরাও করে নাই। খুবই অন্যায় করেছো। ছেলেমেয়েরা ঈদে একটু আনন্দ করতে চায়। কারণ সকলেই করে। তুমি বুঝতে পারো ওরা কত দুঃখ পেয়েছে। আব্বা ও মা শুনলে খুবই রাগ করবেন। আগামী দেখার সময় ওদের সকলকে নিয়ে আসিও। কেন যে চিন্তা করো বুঝি না। আমার কবে মুক্তি হবে তার কোন ঠিক নাই। তোমার একমাত্র কাজ হবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখানো। টাকার দরকার হলে আব্বাকে লেখিও কিছু কিছু মাসে মাসে দিতে পারবেন। হাছিনাকে মন দিয়ে পড়তে বলিও। কামালের স্বাস্থ্য মোটেই ভাল হচ্ছে না। ওকে নিয়ম মতো খেতে বলিও। জামাল যেন মন দিয়ে পড়ে আর ছবি আঁকে। এবার একটা ছবি এঁকে যেন নিয়ে আসে আমি দেখব। রেহানা খুব দুষ্ট ওকে কিছুদিন পরে স্কুলে দিয়ে দিও জামালের সাথে। যদি সময় পাও নিজেও একটু লেখাপড়া করিও। একাকী থাকতে একটু কষ্ট প্রথম প্রথম হতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে কোন চিন্তা নাই। বসে বসে বই পড়ি। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও। ইতি, তোমার মুজিব
এরপরের চিঠি জেল থেকেই লেখা, তাজউদ্দীন আহমদকে। সালটা ‘৬৬… স্নেহের তাজুদ্দিন, আমার স্নেহ ও ভালবাসা নিও। কেমন আছ? খবর জানি না। আমাকে খবর দিও। চিন্তা করিও না। সকলকে ছালাম দিও। শরীরটা বেশী ভাল না তবে কেটে যাচ্ছে। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও। ইতি, তোমার মুজিব ভাই
‘৬৯ সালে জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে লেখা মুজিবরের আরেকটি চিঠিও তুলে ধরা হল … হাছু মনি, আমার স্নেহ ও ভালবাসা নিও। ওয়াজেদের চিঠি পেয়েছিলাম, উত্তরও দিয়েছি বোধ হয় পেয়ে থাকবে। জেল হতে বের হয়ে তোমাকে ভাল করে দেখতেও পারি নাই। শুধু তোমার শরীরের দিকে চেয়ে তোমাকে যেতে দিয়েছি। শরীরের প্রতি যত্ন নিও। ওয়াজেদের শরীর কেমন। আমরা সকলেই ভাল আছি। চিন্তা করে শরীর নষ্ট করিও না। বোধ হয় শুনেছ মানিক ভাই পিন্ডিতে হঠাৎ মারা গিয়েছেন। বুঝতেই পার আমার অবস্থা। প্রফেসর হাই সাহেবও মারা গিয়েছেন। বাংলাদেশের দুইজন কৃতী সন্তান আমরা হারালাম। চিন্তা করিও না। সুইডেন খুব সুন্দর দেশ। তোমাদের খুব ভাল লাগবে। চিঠি দিও। তোমার, আব্বা
এই চিঠিগুলি এটুকুই বোঝা যায়, ব্যক্তিগত জীবনে মুজিবর রহমান ছিলেন পুরোদস্তুর এক পরিবার কেন্দ্রীক মানুষ। প্রতিদিনের কর্মকান্ডের মধ্যেও পরিবারের চিন্তা প্রতিনিয়তই ঘুরপাক খেতে থাকত তাঁর মাথায়। তাঁদের যথাসম্ভব যত্ন নেওয়ারও চেষ্টা করতেন তিনি। নিজে ছিলেন বিপ্লবী। দেশের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে দিয়েছে বহু বলিদানও। নিজের সন্তানদের মধ্যেও সেই দেশাত্ববোধের বীজই রোপণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। সক্ষমও যে হয়েছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। ১৯৭৫য়ে আজকের দিনেই থামে বঙ্গবন্ধুর জীবনরথের সেই চক্র। তবে একজন দেশপ্রেমী বিপ্লবীকে হত্যা করলেও, তাঁর আদর্শকে কোনও দিনই হত্যা করা সম্ভব নয়। আজও ওপার মানুষের মধ্যেই বেঁচে রয়েছে মুজিবরের সেই আদর্শ। যার ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশকে আরও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ব্রতী হয়েছেন দেশের মানুষ।
চিঠিগুলির তথ্যসূত্র : জাতির জনক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাস্ট, পৃ.২১১ পূর্ব পাকিস্তান সরকার, হোম পোল, এফ/এন, ৬০৬-৪৮ পিএফ, খ ৯ পূর্ব পাকিস্তান সরকার, হোম পোল, এফ/এন, ৬০৬-৪৮ পিএফ, খ ২৬
Discussion about this post