“ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান”
স্বাধীন ভারতের যাত্রা পথ ছিল এতোটাই কঠিন। ফাঁসির দড়ি হাসতে হাসতে যারা গলায় পড়েছিলেন তাদের অদম্য জেদ আর লড়াই-ই আজ আমাদের স্বাধীনতা এনেছে। এই বিপ্লবীদের নাম উঠলে যার কথা অন্যতম হয়ে উঠে আসে তিনি হলেন বিপ্লবী দীনেশচন্দ্র মজুমদার। ১৯৩৪ সালের আজকের দিনে কলকাতার সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েছিলেন তিনি। দীনেশচন্দ্র মজুমদারকে পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের ওপর ডালহৌসি স্কোয়ার আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করার কারণে ১৯৩০ সালের ২৫ অগাস্ট গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেদিনের ঘটনায় বিপ্লবীরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও মারা যান বিপ্লবী দলের অন্যতম সদস্য তনুজা সেন। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকাকালীন দীনেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর মা, দাদা অবিনাশ ও বৌদিকে (সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের স্ত্রী বিভাবতী দেবী) বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন। আজ তার আত্ম-বলিদান দিবসে দাদা অবিনাশ ও বৌদি বিভাবতী দেবীকে লেখা সেই চিঠি দুটোই তুলে ধরা হলো আপনাদের জন্য।
চিঠির নং: ২২
আলিপুর সেন্ট্রাল জেল
বর্ষারম্ভ ১৩৪১ (১৪.৪.৩৪)
শ্রীচরণেষু,
পয়লা বোশেখ। শনিবার। নতুন বছর আসবে বলেই বুঝি বুধবারে রাত্রি এবারো প্রথম বৃষ্টি এসে সব কিছু ধুয়ে দিয়ে গেল। একদিনের বৃষ্টিতেই যেন পৃথিবীর রং, গন্ধ বদলে গেল। হাওয়ার গর্জন এসে বাজে কানে। বুঝি কাল বোশেকের হাওয়া। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আজ মনটা তেমনি ভাবে নাচতে চাইছে না। যেমন নেচে উঠত আগে – কত সব না বলে চলে যাওয়া বন্ধুদের জন্য। বিদায় -দিতে -না -চাওয়া বন্ধুর জন্য। আজ ঝোড়ো হাওয়ার ভিতরেও এক শান্তি, গভীরতর শান্তি দেখছি। গর্জনের ভিতরেও এক নীরব, শান্তি ভরা সুর শুনছি। দারুণ কোলাহল, কত রকমের আওয়াজের ভিতরেও যেন সেই এক সুর এসে বাজছে কানে, ঝংকৃত হচ্ছে হৃদয়ের তারে তারে। আজ নববর্ষে তোমাদের প্রণাম করছি সকলকেই। ছোটদের জানাচ্ছি ভালোবাসা।
ইতি
শ্রী দীনেশচন্দ্র মজুমদার পু : ননীবাবু আসেনি । ১১ তারিখ magistrate-এর Court থেকে personal ** disposal হওয়ার কথা ছিল ।কি হল জানি না ।
ইতি দী”
চিঠির নং :২৩
ফাঁসীর আসামী
আলিপুর সেন্ট্রাল জেল
রবিবার ১৬ই বৈশাখ ১৩৪১
শ্রীচরণেষু বৌদি ,
অনেকদিন ইচ্ছে হয়েছে তোমাদের চিঠি লিখি। দোষ হবে ভেবে লিখিনি। আজ মনে হচ্ছে একদিক দিয়ে দোষ হলেও কিছু লেখা আমার উচিত।আজ আর দোষ নেবে না নিশ্চয়ই (বিশেষতঃ তুমি যখন দেখা করে গিয়েছ তখন দোষ নেবে না ) আজ হয়ত কেউ কেউ আমায় দোষ গুণের অতীত বলেই মনে করবে। দাদা ,ছোড়দা ,রাংদাকে আমার প্রণাম জানিও। তুমি , ছোট বৌদি, নতুন বৌদি ,দিদিরা প্রণাম জেনো। মানিক , * * ,পরীকে আমার ভালোবাসা জানিও। তোমাদের ছেলে মেয়েদের আমার আন্তরিক স্নেহাশীষ জানিও। তারা যেন নিজেদের স্বার্থ ছাড়িয়ে উঠতে পারে। অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানব সমাজের ব্যথা যেন মনে প্রাণে অনুভব করতে পারে। অত্যাচারিতদের সঙ্গে যেন নিজেদের এক বলে বুঝতে পারে। সেই ব্যথা বুঝতে পেরে যেন তা দূর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে পারে। নিজেদের যেন ফাঁকি না দেয়। সত্যিকারের যেন কর্মী হতে পারে। এমনি মন এমনি হৃদয় যেন তাদের হয়। তারা যেন এমনই শিক্ষায় গড়ে ওঠে।
ইতি শ্রী দীনেশচন্দ্র মজুমদার
ভারতবাসীকে লড়াই করার শিক্ষা দিয়ে গেছেন দীনেশ চন্দ্র মজুমদার। এমনকি জীবনের শেষ দিনে দাঁড়িয়েও চেষ্টা করেছেন পরিবারের কাছে লড়াইয়ের বার্তা পৌঁছে দিতে। তার মতো বিপ্লবীর এই অদম্য লড়াই ও আত্মত্যাগই আজ স্বাধীন ভারতের অন্যতম ভিত্তিপ্রস্তর।
Discussion about this post