শিল্প ছাড়া সভ্যতার বিকাশ হয়ত কোনোদিন সম্ভব ছিল না। প্রাচীনের পাথরের যুগ থেকে আজকের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বাহার সবটাই তো সম্ভব হয়েছে শিল্পের হাত ধরেই। এসেছে একের পর এক শিল্পবিপ্লব। আমাদের দেশও সেই বিপ্লব থেকে পিছিয়ে না থেকে তরতরিয়ে উঠেছে শীর্ষস্থানে। আর যদি বলি আদি বাংলার কথা তবে একটাই নাম মুখে আসবে, তা হল হুগলি শিল্পাঞ্চল। উত্তরে ত্রিবেণী-কল্যাণী থেকে দক্ষিণে উলুবেড়িয়া-বিড়লাপুর গোটা ১০০ কিমি লম্বা ও ১০-১৫ কিমি চওড়া এই সমগ্র অঞ্চল ছিল বাংলা শিল্পের আঁতুড়ঘর। ভারতের প্রাচীন ও দ্বিতীয় বৃহত্তম হুগলি তথা কলকাতা শিল্পাঞ্চল। আর এর মধ্যে বিশেষ খ্যাতনামা শিল্প হল চামড়াশিল্প। শুধু আজকের নয় সেই আদি থেকেই কলকাতা লেদার কমপ্লেক্সের রয়েছে নামডাক ওয়ালা এক রমরমা বাজার।
সালটা ১৭১৭। মুঘল সম্রাট ফারুখসিয়রের থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি ভাড়ায় হুগলি নদী তীরবর্তী ৩৪ টি গ্রামের শর্তসাপেক্ষ অধিকার আদায় করে। কিন্তু ১৭৫৮ এর পর মির্জাফরের থেকে ওই এলাকাগুলিকে যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে কিনে ফেলে কোম্পানি। এরপর কলকাতা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে চামড়াশিল্পের প্রাণভূমি। কাঁচামাল থেকে পণ্য উৎপাদন একাহাতে সামলাত এই কলকাতা শিল্পাঞ্চল। ৫০০ টি ট্যানারি অর্থাৎ চামড়া পাকিয়ে দ্রব্য তৈরীর বড়সড় কারখানা ছিল এখানে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো নিকটবর্তী জনপদ। ট্যাংরা, তিলজলা, ধাপার, তোপসিয়া এই গ্রামগুলিতে তখন বাস করত উত্তরপ্রদেশ ও বিহার থেকে পালিয়ে আসা পীড়িত দলিতরা। চীনা সম্প্রদায়েরও বাসভূমি এই গ্রামগুলি। ফলে খোলা জল নিকাশি ব্যবস্থা, খোলা চিমনি থেকে ছুটে আসা তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত রাসায়নিক গ্যাসে পরিবেশ হয়ে উঠেছিল চরম অস্বাস্থ্যকর। বস্তির মানুষরা একে একে টিবির মতো তৎকালীন মারণ রোগের শিকার হতে থাকে।
১৯৯৬ এর ১৯ ডিসেম্বর তাই সুপ্রিম কোর্ট ভাঙড়ের বানতলায় ‘কলকাতা চামড়া কমপ্লেক্স’এর স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়। সেই থেকে এক এক করে ঝাপ পড়ে কমপ্লেক্সের দোকানগুলোতে। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে কয়েকশ’ চামড়া কারখানা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ২৮ কিমি দূরে বানতলায়। ২০০৭ সালের মধ্যে ৫৫০ টি ট্যানারি নিয়ে গড়ে ওঠে বানতলা চর্মনগরী। কিন্তু সেখানে পৌঁছেও সেই এক কান্ডের সম্মুখীন। চাষের প্রভূত ক্ষতিসাধন। শ্বাসপ্রশ্বাসে মিশছে বিষাক্ত বায়ু। শুরু হয় অতিষ্ট গ্রামবাসীদের বিক্ষোভ হরতাল। বর্তমানে যদিও ৫০টির মতো বেআইনি ট্যানারিকে বন্ধ করা হয়েছে প্রশাসনিক পদ্ধতিতে। ওদিকে আবার চীনাদের পরিবেশ বান্ধব কিছু ট্যানারির দৌলতে এখনও কলকাতা চামড়া কমপ্লেক্সে পার্স, মানিব্যাগ, পোর্টফলিও জুতো ইত্যাদি উন্নতমানের দ্রব্য তৈরী হয়ে চলেছে। তাদের এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে ক্রোম, ফর্মালডিহাইড, ভারী ধাতু (অ্যালুমিনিয়াম, আর্সেনিক, কোবাল্ট, তামা, নিকেল ইত্যাদি), অ্যালকাইল ফেনল ইথোক্সাইল্যাটস, শর্ট চেইন ক্লোরিনযুক্ত প্যারাফিনস, উদ্বায়ী জৈব যৌগ এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক রাসায়নিকগুলি থেকে কিছুটা হলেও নিস্তার পাওয়া গিয়েছে।
বানতলা কমপ্লেক্সের ইউনিট পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সহায়তায় পেয়েছে এক সম্মতিপত্র। এদিকে করোনা থেকে শুরু নানা কারণের সূত্রধর চীন থেকে বিশ্ববাজার মুখ ঘুরিয়েছে। অগত্যা ইউরোপ আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোর কাছে চর্মদ্রব্য জোগানের একটাই ঠিকানা দাঁড়িয়েছে। তা হল বাংলার এই বানতলা চর্মশিল্প। তাই কোটি টাকার লগ্নি হচ্ছে বানতলায়। তবে শিল্প কখনোই জনজাতির ক্ষতিসাধনে গড়ে উঠতে পারে না। যেকোন কারখানার প্রস্তুতিপর্বে তাই পরিবেশ দূষণের ব্যপারটি আর এড়ালে চলবে না। উপযুক্ত ব্যবস্থা সহযোগে তৈরী কারখানা একান্ত গ্রাহ্য। বিশ্বের সমস্ত শিল্প যদি দূষণ নিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভূমিকা নেয় তবেই সবুজে ঘেরা এই ভূখন্ড বহুকাল থাকবে মানবজাতির বাসভূমি হয়ে।
তথ্য ঋণ – প্রগতি মিত্র, প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – Kolkata Phototours
Discussion about this post