পুরাণ মতে শ্রী লক্ষ্মী হলেন সম্পদের দেবী। শ্রী, সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যের দেবী হিসেবে বহু যুগ ধরেই হিন্দু ঘরে ঘরে পূজিত হয়ে আসছেন দেবী লক্ষ্মী। হিন্দু সংস্কৃতি অনুসারে, মা লক্ষ্মীর আরাধনার জন্য এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সরা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই সরাকে বলা হয় ‘লক্ষ্মী সরা’। তবে পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ্মী সরায় দেবী-বন্দনা হলেও এর জন্ম কিন্ত এ দেশে নয়। বরং ওপার বাংলাতেই। কিন্তু কীভাবে বাংলাদেশের এক শিল্প ছড়িয়ে পড়ল এ দেশের মাটিতে? আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই কাহিনীই।
মূলতঃ কৃষিকাজ এবং সোনার ফসলেই সমৃদ্ধ ওপার বাংলার পদ্মাপাড়ের মাটি। সম্পদ এবং সমৃদ্ধির দেবী হিসেবে সে দেশে তাই বিপুল প্রচলিত লক্ষ্মীর আরাধনাও। হিন্দু মতে আশ্বিনের সময়ের পূর্ণিমায় হয় ‘কোজাগরী’ লক্ষ্মী পুজো। ‘কোজাগর’ কথার অর্থ কঃ (কে) জাগর (জেগে রয়) অর্থাৎ কে জেগে রয়েছে? লোককথা অনুযায়ী, আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা রাত্রে লক্ষ্মী পুজোর দিন স্বয়ং দেবী প্রত্যেকের বাড়ি যান। দেখেন রাত্রে তাঁর অপেক্ষায় কে জেগে রয়েছে। তাঁকে ডেকে বলেন‒ “নারকেলের জল পান করে যে জেগে আছে, তাকে আমি সব সম্পদ দেব।” এর আগে লক্ষ্মীর পট বসিয়েই হতো পুজো। তবে পরবর্তীতে কোজাগরী পূর্ণিমাকে ভিত্তি করেই লক্ষ্মীসরার প্রচলন হয় অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর এবং ঢাকা অঞ্চলে। কালক্রমে ওপার বাংলার সংস্কৃতিতেও নিজস্ব এক স্থান দখল করে লক্ষ্মীসরা।
লক্ষ্মীসরা তৈরির আগে থেকেই ওই অঞ্চলের কুমোররা পট শিল্পে বেশ বিখ্যাত ছিলেন। পূর্ব বঙ্গে লক্ষ্মী সরা তৈরি হতো বড় থালা আকৃতির। এর ওপরের সমতল অংশে দেবী লক্ষ্মী এবং পেঁচা, ধানের শীষ, বিভিন্ন ছবিও আঁকা থাকতো। আবার অনেক সরায় প্রাধান্য পেতেন মা দুর্গা। সেখানে লক্ষ্মী এবং অন্যান্য ছবি আঁকা হতো ছোট করেই। ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্মের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও ব্যবহার করতে শুরু করেছিল সেই সরা। তবে সেই সরা গুলিতে আঁকা থাকতো অন্যান্য ছবি। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা আঁকতেন রাধা কৃষ্ণের ছবি। তেমনই শাক্তরা মহাদেবের। তবে আঁকা যা-ই হোক না কেন, সরা নাম হিসাবে ‘লক্ষ্মীসরা’ই প্রাধান্য পেয়েছিল। তবে যাঁরা মাটির প্রতিমা গড়তেন তাঁরা সরা শিল্পকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। সরার আঁকা গুলিকে পুতুল হিসাবেই সম্বোধন করতেন তাঁরা। এমন ভাবেই সরার আঁকার সংখ্যা অনুযায়ী সেগুলিকে ‘দুই পুতুল’ বা ‘তিন পুতুল’ অথবা ‘চার পুতুল’, এভাবেও ডাকা হয়ে থাকতো।
বাংলাদেশে একসময় হিন্দু ধর্ম ছাড়িয়েও মুসলিমরা ব্যবহার করতে থাকেন এই সরা। তাঁদের সরায় কাবার ছবির সঙ্গেই বিভিন্ন সংখ্যার মান লেখা থাকত। তাকে বলা হতো ‘গনকী সরা’। বাংলাদেশে মোট চার রকমের সরা পাওয়া যেত- গনকী সরা, ঢাকাই সরা, ফরিদপুরী সরা এবং সুরেশ্বরী সরা। এরপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সরা শিল্পীরা চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গে। কাঁটার বেড়াজালের গণ্ডি পেরিয়ে এ দেশে লক্ষ্মীসরার নতুন যাত্রা শুরু হয়। এভাবেই ধর্মের বেড়াজাল ভেঙে দু দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সম্প্রীতির এক মন্ত্র। তবে বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ দু দেশেই এই শিল্প প্রায় বিলুপ্তপ্রায়ই বলা চলে। সরার বদলে আজ মাটির তৈরি লক্ষ্মী প্রতিমায় চলছে দেবীর আরাধনা। ফলতঃ বাংলার সংস্কৃতি থেকে প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছে প্রাচীন এই শিল্প।
তথ্য ঋণ – প্রদীপ্ত ইকারাস
Discussion about this post