“ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে/ জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।” পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে প্রতিদিন এক মানুষ হাঁটেন। হাতে তাঁর খবরের বোঝা। বয়স সত্তরের কোঠায়। এককালে বাংলার গ্রামাঞ্চলে চিঠি পৌঁছনোর একমাত্র ভরসা ছিলেন ডাক-হরকারা বা রানাররা। ঝুলি কাঁধে, ঘুঙুরের শব্দে তাঁরা পৌঁছে দিতেন খবর। আজ রেলপথ, মোবাইল ফোন রানারদের বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে। তবু, পুরুলিয়ার সেই মানুষ সময় আর ইতিহাসের সঙ্গে দৌড়ে চলেছেন। তাঁকে সকলে ভালোবেসে ডাকে কালিপদ দা। তিনি কালিপদ মুরা।
কালিপদ মুরা প্রতিদিন পাহাড়ি রাস্তা হেঁটে বা দৌড়ে পৌঁছে দেন চিঠি, মানি-অর্ডার বা ছোটখাটো পার্সেল। তাঁর কর্মস্থল অযোধ্যা হিলটপ পোস্ট অফিস। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি কিছুই তাঁকে থামাতে পারে না। সামান্য পারিশ্রমিক আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যেও তিনি থেমে যাননি। তাঁর জীবনে কোনো অভিযোগ নেই। তিনি জানেন, গ্রামের মানুষ তাঁর অপেক্ষায় থাকে। তাঁর কাছেই থাকে দূরের ছেলে-মেয়ের খবর, শহরের আত্মীয়ের চিঠি, কখনও উৎসবের আনন্দ, কখনও আবার শোকের সংবাদ।
কালিপদ মুরার জীবন যেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই রানার কবিতার প্রতিচ্ছবি। “রানার! গ্রামের রানার!/ সময় হয়েছে নতুন খবর আনার”। কালিপদ মুরার পদক্ষেপ শুধু ডাকের ঝুলি নয়, বহন করে মানুষের আশা, সম্পর্কের বন্ধন আর বেঁচে থাকার শক্তি। আজ যন্ত্রের যুগে যখন মোবাইল ফোনে এক মুহূর্তে খবর পেয়ে যান সকলে, তখনও চলছে কালিপদ মুরার নিরলস পথচলা।
কালীপদ মুরাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি ডকুমেন্টারি; যার নাম “The Last Run” (Telegraph India, 2021)। এতে তাঁর প্রতিদিনের সংগ্রাম, একাকিত্ব এবং অক্লান্ত জীবনপথ ফুটে উঠেছে। কালিপদ মুরা সত্যিই আমাদের সময়ের শেষ ডাক রানার। হয়তো একদিন ইতিহাসে লেখা হবে ‘শেষ রানার’এর নাম। তবে, তাঁর গ্রামবাসীদের কাছে তিনি চিরকাল থাকবেন খবরের বাহক, আশার আলো, প্রাণের মানুষ হিসাবে। যিনি যান্ত্রিক দুনিয়ায় মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন হৃদয়ের ছোঁয়া।
Discussion about this post