কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর জনপ্রিয়তা গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র পূজো নয় বিসর্জনের জন্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এই শহর। সাং বেঁধে বেয়ারারা কাঁধে করে প্রতিমা নিয়ে রাজবাড়ী ঘুরিয়ে বিসর্জন দেওয়ার রীতি এখনও চলছে। সাং বেঁধে কাঁধে করে ঠাকুর নিয়ে যাওয়া কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্য। ছোট বড়ো মিলিয়ে মোট সাড়ে তিনশোর বেশি ঠাকুর হয়। সব ঠাকুর কাঁধে করে না নিয়ে গেলেও প্রতিটা ঠাকুর রাজবাড়ী ঘুরে প্রতিমা বিসর্জন ঘাটের দিকে অগ্রসর হয়। একমাত্র এই রীতির ব্যতিক্রম ঘটে নেদেরপাড়ার ক্ষেত্রে।
জগদ্ধাত্রী পুজো প্রথম বাংলার নদিয়ার কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র শুরু করেন। কৃষ্ণনগরে, নদীয়া, রাজ রাজেশ্বরীতে, জগদ্ধাত্রী পুজো বাংলার অন্যতম প্রাচীন জগদ্ধাত্রী পুজো। জনশ্রুতি রয়েছে যে একবার বাংলায় নবাব রাজের সময় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে সময় মতো কর না দেওয়ার কারণে তাঁকে নবাব সিরাজদ্দৌলা গ্রেফতার করেছিলেন। বিজয়া দশমীর দিন তাঁকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল যার কারণে তিনি তাঁর রাজ্যে দূর্গা পুজো সম্পন্ন করতে পারেননি। এরপর মহারাজা এই জগদ্ধাত্রী পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছিলেন, জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু হয়েছিল। লোক কথায় রয়েছে যে এই পূজাটি ১৭৮৮ সালে শুরু হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এই পুজোটি এক রাজ রাজেশ্বরী (রাজ মাতা) বাংলা ভাষার দ্বারা করা হয়েছিল। জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করার আগে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ১১ টাকা অনুদান সহ মালোপাড়া বারোয়ারিতে জগদ্ধাত্রী পূজার অনুমতি দেন, যা মা জলেশ্বরী নামে পরিচিত।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়কালে রাণী তাঁর রাজ্যের সমস্ত প্রতিমা দর্শন করতেন এবং শ্রেষ্ঠ প্রতিমা পুরষ্কৃত করতেন। পরে রাণীর বয়স হয়ে যাওয়ার সমস্ত প্রতিমা রাজবাড়ীর নৌবৎখানা ঘুরিয়ে রাণীমাকে প্রতিমা দর্শন করে তারপর প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া শুরু করে। এরপর থেকে এই রীতি থেকে যায়। সমস্ত ঠাকুর সে কৃষ্ণনগরের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন রাজবাড়ী ঘুরিয়ে তারপর কদমতলা ঘাটের দিকে রওনা হয়। একমাত্র নেদেরপাড়ার এই রীতি মেনে চলে না তারা রাজার সময় থেকেই বারোয়ারী থেকে সোজা বিসর্জন ঘাট যায়। পাড়ার নামকরণ থেকেই এই ব্যতিক্রমের কারণ সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায়। না-দিয়ার পাড়া অর্থাৎ এই অঞ্চলের মানুষরা রাজার আমলে কর দিতে না। তারপর থেকেই এই পাড়ার নাম না-দিয়ার পাড়া বা চলতি কথাই নেদেরপাড়া হয়। নেদেরপাড়ার প্রতিমাকে রাজবাড়ী দর্শনের অনুমতি ছিলনা। সেই রীতি তারা এখনো মেনে সরাসরি বিসর্জন দেয়।
বর্তমানে এই অতিমারী পরিস্থিতিতে কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্য আজ সঙ্কটের মুখে। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে প্রশাসন এবার সাং বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে আর বিসর্জন হবে একমুখী অর্থাৎ কোন ঠাকুরই এবার রাজবাড়ী যাবেনা। বিসর্জন দেখতে কৃষ্ণনগরের দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এসে শহরের রাজপথে ভিড় জমায়। সেই কারণে করোনা মোকাবেলায় প্রশাসন সমস্ত শভাযাত্রা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। অবশ্য এতে কৃষ্ণনগরবাসী বেজায় চটেছেন প্রশাসনের ওপর।
Discussion about this post