উৎসবের দেশ ভারতবর্ষে রামাদানের পবিত্র মাস অসীম গুরুত্ব বহন করে। এক মাস ব্যাপী রোজা পালন করে মুসলিমরা আসমানে কাঙ্খিত চাঁদের অপেক্ষায় থাকেন। পালিত হয় পরের দিনই দুনিয়া জুড়ে মিষ্টি ঈদের উৎসব। হজরত মহম্মদের মক্কা ছেড়ে অনুগামীদের নিয়ে মদিনা যাত্রার স্মৃতিকে মনের মণিকোঠায় অমর উজ্জ্বল করে রাখাই উৎসবের উদ্দেশ্য একমাস ফজর ও মাগরিবের নামাজের মধ্যবর্তী সময়ের উপোস অতিক্রান্ত করে পবিত্র মনে মুসলিমরা একজোট হয়ে ইফতার সারেন খুশি মনে। থালায় সেজে ওঠে মরশুমি ফল, তেলেভাজা, কাবাব, নানা রকমের মিষ্টি ও শরবত। ইফতার আয়োজনে যোগান দিতে তাই সেজে ওঠে ইফতার বাজারও। সেজে ওঠে কলকাতার ইফতার বাজারও। নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন চিৎপুর-জাকারিয়া স্ট্রিটের ইফতার ঘিরে জাঁকজমক হয় দেখার মতো। যেন এক টুকরো মধ্যপ্রাচ্য হাজির হয়েছে ম্যাজিক কার্পেটে!
মহাত্মা গান্ধী মেট্রো থেকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে ডান দিকে ঘুরতেই পড়ে সত্তর বছর পেরোনো রুমী স্টোর্স। কর্ণধার বর্ষীয়ান মহঃ মাকসুদ মঞ্জর। খেজুর, কাজু, কিসমিস, পেস্তা-বাদাম ও চেরিফলের সম্ভ্রম জাগানো সম্ভার লক্ষ্য করা যায় সহজেই। আলজিরিয়া, ইরান ও ইরাক থেকে আনা খেজুরের দাম ১২০ থেকে ৩০০ টাকা প্রতি কেজি দরে পাওয়া যাচ্ছে তার দোকানে। রয়েছে পবিত্র মদিনা থেকে আমদানি করা স্পেশাল খেজুর। দাম পড়বে ৭২০ টাকা প্রতি কেজি। পড়শী রাজ্য উড়িষ্যা ও সমুদ্র নগরী দীঘা থেকে আনা কাজু বিক্রি হচ্ছে ৬৪০ টাকা প্রতি কেজি দরে। রয়েছে ২০০ টাকা প্রতি কেজি দরে নাসিক থেকে আমদানি করা কিসমিস। মাকসুদ মঞ্জর বলেন রোজার মাসে আশানুরূপ ব্যবসা হচ্ছে না। কারণ হিসেবে ভোগ্যপণ্যের অগ্নিমূল্য ও পকেটের টানকে চিহ্নিত করেন প্রবীণ ব্যবসায়ী। ঠিক একই সুরে ফল ব্যবসায়ী মহঃ সোহরাব মন্দ ব্যবসার কথা অকপটে স্বীকার করে নেন। তার দোকানে আপেল ২২০ টাকা কেজি, মৌসুম্বী ৬০ টাকা কেজি, তরমুজ ৩০ টাকা কেজি, পাকা কলা ৭২টাকা ডজন, আনারস ১০০ টাকা কেজি, বেদানা ১৫০ টাকা কেজি ও আঙ্গুর ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
তীব্র গরমের হাত থেকে নির্জলা উপবাসকারীদের গলা ভেজাতে রয়েছে দেদার শরবতের আয়োজন। পুদিনা, লেবুজল, ফলের রস ও রূহ আফজাহ পাওয়া যাচ্ছে ১০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। ঈদ উৎসবে প্রধান খাদ্য সিমুইয়ের বিপুল আয়োজন রয়েছে মসজিদ সংলগ্ন বাজারে। শতক পেরোনো সিমুইয়ের দোকান কাদিমী স্টোরে ভাজা সিমুই পাওয়া যাচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে। লাচ্ছা সিমুইয়ের দাম পড়ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা কেজির মধ্যে। সিমুইয়ের জন্য আবশ্যক মশলা- মিক্সড ড্রাই ফ্রুটের প্যাকেট খোলা বাজারে ২০ ও ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে চত্ত্বর জুড়ে। রয়েছে স্থানীয় বেকারির নান খাটাই, নান ব্রেড, টোস্ট ও নানা রকমের মিষ্টি বিস্কুটের আয়োজন। চলছে খোলা বাজারে ঘুগনি ও তেলেভাজার কেনাবেচা। ৫ থেকে ১০ টাকার মধ্যে কেনা যাচ্ছে মুখরোচক গরম গরম মশলাদার খাবারগুলি। রয়েছে করাচি হালুয়া, প্যাঁড়া, পেঠা, দিলখুশ ও আফলাতুন নামক বিশেষ ধরণের হালুয়ার আয়োজন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। রেঁস্তোরাগুলোয় রয়েছে নানা ধরনের কাবাব, কোর্মা, নীহারি, হালিম, পরোটা, বিরিয়ানি ও সুস্বাদু ফিরনির আয়োজন।
দিবস ব্যাপী নির্জলা উপবাসের পর ঈশ্বর আরাধনায় মগ্ন মুসলিমদের ইফতার পার্টিতে যোগ দেন জাত-পাত-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে লোকজন। উৎসবের প্রাঙ্গণে তাই ধুয়ে মুছে যায় ব্যবধানের সব রেখা। সম্প্রীতির, ভ্রাতৃত্বের, বন্ধুত্বের, ভালোবাসার সম্মিলিত সুরে ঈদের আবহ, ঈদের মঞ্চ সেজে ওঠে আফতাবে। দিনের শেষে ইফতারের সৌজন্যে বিশ্ব মানবতাই যেন পূজিত হয় মহা সমারোহে। ইফতারের থালা ঘিরে ফারাক ভুলে বৈষম্যের ঊর্ধ্বে ওঠা মানুষজন সম্মতির শিলমোহর দেন সেই অভ্রান্ত বিশ্ব-দর্শনকে যা বলে- আমরা আসলে এক ও অখণ্ড ঈশ্বরেরই সন্তান।
Discussion about this post