মাত্র একটা আঙুলের ছাপ! আর সেই ছাপই চিনিয়ে দিল অপরাধীকে। হ্যাঁ, গল্প-উপন্যাস হোক বা কোনও গোয়েন্দা সিনেমা; আমরা প্রায়ই দেখে থাকি আঙুলের ছাপের সাহায্যে অপরাধীকে চিহ্নিত করার পদ্ধতি। যদিও কোনও অপরাধস্থল থেকে পাওয়া আঙুলের ছাপ নিয়ে সন্দেহভাজন কারোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখার এই বিষয়টি নেহাতই সাম্প্রতিক বিষয় নয়। বরং সেই আঠেরোশো শতক থেকেই গোয়েন্দা এবং পুলিশ মহলে বহুলস্বীকৃত এই পদ্ধতি। তবে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে অপরাধী শনাক্তকরণের প্রায় নির্ভুল এই পদ্ধতিটি ঠিক কার মস্তিষ্কপ্রসূত? শুনলে অবাক হবেন, এটির জন্ম খোদ কলকাতাতেই। এবং তার খোঁজ পেতে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে অতীতে…
ছোটবেলা থেকে আমরা যারা গোয়েন্দা গল্পের পোকা তাদের নিশ্চয়ই সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’র চরিত্র সিধু জ্যাঠার ফেলুদাকে করা সেই প্রশ্নটা এখনও মনে আছে- “উইলিয়াম জেমস হার্শেল কে ছিলেন?” এই হার্শেল ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি আঙুলের ছাপের সাহায্যে যে কোনও মানুষকে শনাক্তকরণে ছিলেন পথিকৃৎ। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা বিভাগ মানা হয় যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে, তাদেরও নিজস্ব ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯০১ সাল অব্ধি। অথচ তারও কিছু বছর আগেই কলকাতা পেয়ে যায় আঙুলের ছাপ শনাক্তকরণের নিজস্ব সংস্থা।
১৮৯৭ সালের জুন মাস। স্যার এডওয়ার্ড হেনরী, খান বাহাদুর আজিজুল হক এবং রায় বাহাদুর হেমচন্দ্র বসুর প্রচেষ্টায় বিশ্বের প্রথম সরকারি ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো’ স্থাপিত হয় কলকাতায়। ১৮১৯ সালে আঙুলের ছাপের সাহায্যে অপরাধীকে শনাক্ত এবং তাদের শ্রেণীবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় স্যার হেনরী বেশ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। সেই পরীক্ষার ওপর নির্ভর করেই হেমচন্দ্র বসু এবং আজিজুল হক আঙ্গুলের ছাপের শ্রেণিবিন্যাসের জন্য গাণিতিক পদ্ধতির কাজ করছিলেন। ১৮৯৭’র মার্চ মাসে একটি সরকারি কমিটি অপরাধীদের শনাক্ত করার জন্য আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহারকে অনুমোদিত করে। যার ফলস্বরুপ একই বছর কলকাতায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয়।
সে বছরই ১লা অগাস্ট, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার কাঁঠালগুঁড়ি টি-এস্টেটের ম্যানেজার হৃদয়নাথ ঘোষকে তাঁরই বাংলোতে নির্মমভাবে খুন করা হয়। গলায় ছিল এক গভীর কাটার দাগ। সন্দেহভাজনদের তালিকায় প্রথমেই ছিলেন তাঁর প্রাক্তন গৃহকর্মী রঞ্জন সিং ওরফে ‘কাঙ্গালি’ যিনি চুরির জন্য সবেমাত্র ছয় মাসের জেল খেটে এসেছেন। ঘটনাস্থলে পাওয়া গিয়েছিল রক্তাক্ত আঙ্গুলের ছাপ। সেই ছাপের সাহায্যেই পুলিশ কাঙ্গালিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছিল। সে-ই প্রথম! বিশ্বে প্রথমবার আঙ্গুলের ছাপের সাহায্যে অপরাধীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল তখনই। যদিও সেবছরই ২৫ মে রঞ্জন সিংকে আদালত খালাস করে দেয়। কারণ তখনও ভারতীয় আইনে আঙ্গুলের ছাপের সাহায্যে অপরাধ প্রমাণের এবং সেই ভিত্তিতে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার কোনো বিধান ছিল না। এরপর ১৮৯৯ সালে ভারতীয় আইনসভা একটি সংশোধনী আইন পাশ করে। আঙ্গুলের ছাপ দ্বারা সাক্ষ্য প্রমাণের অনুমতি মেলে সেই আইনে।
যদিও আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার পরেও সেসময় তাঁদের কাজের জন্য কোনও স্বীকৃতিই পাননি হেমচন্দ্র বসু এবং আজিজুল হক। তবে সম্প্রতি ইংল্যান্ডের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সোসাইটি হক এবং বসুর নামে একটি গবেষণা পুরস্কার চালু করেছে। তাই বলা যেতেই পারে কয়েক শতক দেরি হলেও অপরাধ জগতের পথপ্রদর্শক হিসাবে বাঙলিকে এক যোগ্য সম্মান এনে দিয়েছেন তাঁরা। কে বলে বাঙালির জাতি আজও পিছিয়ে? এই দুই বাঙালি পুলিশের হাত ধরেই তো আজ অপরাধ জগতে এখন নতুন দিশার সন্ধান পেয়েছে বিশ্ব। এই দুই রক্ত মাংসের বাঙালি দেখিয়ে দিয়েছেন গোয়েন্দাগিরিতে শুধু বিদেশীরাই নয়, বাঙালি পুলিশরাও কিছু কম যান না!
Discussion about this post