আজকের দিনে বিশ্বায়নে জোয়ার এসে লাগছে স্বাতন্ত্র্যের দরজায়। এর দাপট এতটাই প্রকট যে তার চাপে শহর এবং মানুষ তার নিজস্বতা , স্বাতন্ত্র্য, বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলছে প্রতিটা দিন। সেখানে একটা শহরের প্রাণ খোলা আবেগের প্রকাশ আমাদের ভরসা দেয়। আর সেই শহর আমাদের কলকাতা। প্রাণ আছে, এখনও প্রাণ আছে। এই প্রাণের উচ্ছ্বাসই আসল কলকাতা, তার বাড়ি ঘর দোরের মলিন চেহারার পিছনে যে তা সুপ্ত। এই উচ্ছ্বাসের সামগ্রিক প্রকাশ দেখা যায় দুর্গাপুজোয় । একটু পিছনের দিকে যদি ফিরে তাকানো যায় তবে পুরনো কলকাতার পুজো ফিরিঙ্গি সাহেবদের চোখেও বিশেষভাবে আর্কষণীয় হয়ে উঠেছিল। ১৭৯৯ সালে অষ্টাদশ শতাব্দী পরবর্তী শতাব্দীতে পড়ার আগে বেলজিয়াম চিত্রকর প্রথম দেবীর চিত্র অঙ্কন করেন। সেটাই সর্ব প্রথম কোন ফিরিঙ্গির চোখে দেবী রূপ প্রকাশিত হয়। এমনই এক পুজো হল লাহা বাড়ির পুজো। যেখানে দেবী দুর্গা বসেন পতিদেব শিব ঠাকুরের কোলে।
এ বাড়ির পুজো সব রকম আঙ্গিকেই অন্যভাবে উপস্থাপিত হয়। দেবীর হাতে থাকে না কোনও অস্ত্র, পায়ের কাছে থাকে না মহিষাসুরও। কারণ লাহা বাড়িতে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দেবী পূজিতা হন না। এখানে তিনি অভয়া বা হরগৌরী রূপে পূজিতা হন। দুর্গা প্রতিমার সঙ্গে পূজিত হন লাহাবাড়ির কুলদেবী জয়জয় মা। যেটা একটা অষ্টধাতুর সিংহবাহিনী মূর্তি। আরও একটা প্রথা চালু আছে এই বাড়িতে। দুর্গা প্রতিমা তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় একটি ছোট্ট গণেশ। যতদিন না প্রতিমা সম্পূর্ণ হচ্ছে এই গণেশের পুজো হয়। বড় গণেশ তৈরি হলে তাঁর পেটে ছোট গণেশ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। নবমীর দিন মাকে ‘কোল হাঁড়ি’ দেওয়া হয়। এটা খই, মুড়কি আর মিষ্টি ভরা ছোট্ট একটা হাঁড়ি। নিরঞ্জনের জন্য প্রতিমা বাড়ির বাইরে গেলেই মেয়েরা দরজা বন্ধ করে দেন। বিসর্জন দিয়ে বাড়ি ফিরে পুরুষরা তিনবার জিজ্ঞাসা করেন, “মা আছেন ঘরে?” মেয়েরা বলেন “হ্যাঁ, মা আছেন ঘরে।” তারপর খোলা হয় দরজা। সন্ধি পুজোর সময় বাড়ির মহিলাদের দুই হাতে আর মাথায় মাটির সরাতে ধুনো জ্বালিয়ে বসতে হয়।
আজও আমাদের শহরের বুকে বাড়ি গুলোর পুজো হারিয়ে যায় নি। আসলে কলকাতার পুজো স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সৃষ্টিকলার এক অদ্ভুত মানবিক প্রকাশ। এর অভিব্যক্তি এত সামগ্রিক যে বিক্ষিপ্ত ভাবে তার আন্দাজ হয় না।
চিত্র ঋণ – বং গ্রাফ, প্রসূন দত্ত
Discussion about this post