ম্যারাথন দৌড়ের ইতিহাস মোটামুটি সকলেরই প্রায় জানা। সেই প্রাচীন অলিম্পিক থেকে শুরু করে আধুনিক অলিম্পিক, ২৬ মাইলের ম্যারাথন তার গরিমা ধরে রেখেছে আজও। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় মেয়েরা কবে থেকে ম্যারাথন দৌড়তে শুরু করেছে, উত্তরটা হয়ত অনেকেরই অজানা। তখনকার দিনে সেকেলে সমাজে মেয়েদের ম্যারাথন দৌড়ানো নিয়ে কিছু প্রচলিত ধারনা ছিল। মনে করা হত মেয়েদের ম্যারাথন দৌড়নো উচিৎ নয়। মেয়েদের পা ২৬ মাইল দৌড়নোর জন্য উপযুক্ত নয়। আর যদি দৌড়ের প্রস্তুতিও নেয়, তবে মেয়েদের বুকে চুল গজাতে শুরু করবে, গোঁফ-দাঁড়ি বেরিয়ে যাবে, জনন তন্ত্র খুলে বেরিয়ে চলে আসবে ইত্যাদি অদ্ভুত সব ধারণা ছিল।
প্রতিবছরের মতই ১৯৬৭ সালে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বোস্টন ম্যারাথন শুরু হয়। শয়ে শয়ে প্রতিযোগী ২৬ মাইল ম্যারাথনে নিজেদের উজাড় করে দেওয়ার জন্য দৌঁড়তে শুরু করল। হঠাৎ সবাই লক্ষ্য করল হাজার হাজার পুরুষ প্রতিযোগীর মাঝে একজন মহিলাও। ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল, পরিপাটি করে বাঁধা চুল! হ্যাঁ, একজন মহিলাই বুকে ২৬১ নাম্বারের বিব পরে দৌড়চ্ছেন ম্যারাথনে। বোস্টন ম্যারাথনের জন্য প্রতি বছর পৃথিবীর নানা প্রান্তের হাজার হাজার প্রতিযোগী আবেদন পাঠান। তার মধ্যে মহিলাদের নাম বাতিল করে দেওয়া হত প্রচণ্ড যত্ন সহকারে। ১৯৬৬ সালে বোস্টন ম্যারাথনে রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই মাঝপথে ঢুকে পড়েন এক মহিলা, নাম রোবার্তা গিব। এই ঘটনাই ক্যাথারিন সুইজারের মাথায় জেদ চাপিয়ে দেয়। তিনি টার্গেট করলেন ১৯৬৭-এর ম্যারাথনকে। দৌড়ের আবেদনে নিজের নাম পাঠান তিনি কে. এস নাম দিয়ে। তিনি শুধুমাত্র নামের আদ্যক্ষরগুলো ব্যবহার করেছিলেন। রেস কর্তারা তাই খেয়াল করেন নি যে আবেদনকারী একজন মহিলা। ক্যাথারিনের বয়ফ্রেন্ড বিব নাম্বারটি সংগ্রহ করে আনেন এবং তারপর শুরু হয় দৌড়।
দৌড় শুরু হওয়ার পর রেস কর্তারা জানতে পারেন যে প্রতিযোগীদের মধ্যে একজন মহিলাও রয়েছেন। পুরুষদের দৌড়ে একজন মহিলা দৌড়চ্ছেন, এই অপমান সহ্য হল না তাঁদের। তাই চার কিলোমিটার দৌড়ের পরেই রেসকর্তারা চড়াও হতে শুরু করেন। তাঁর বুকের কাছ থেকে বারে বারে বিবটি ছিঁড়ে নেওয়ার চেষ্টাও চলতে থাকে সমান তালে। তবে ক্যাথারিন কিন্তু নিজের লক্ষ্যে স্থির ছিলেন। তাঁকে আগলে রেখেছিলেন তার কোচ, বয়ফ্রেন্ড আর বাকি কিছু রানার। ক্যাথারিন সেদিন শুধু ২৬ মাইলেই থেমে থাকেননি। তিনি দৌড়েছিলেন আরও ৫ মাইল। বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে দেখেছিল, ক্লান্তি ছাড়াই মেয়েরাও দৌড়তে পারে ঘন্টার পর ঘন্টা, শেষ করতে পারে ম্যারাথন দৌড়ও।
শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে বোস্টন ম্যারাথনে মহিলারাও অংশগ্রহণ করতে থাকেন। যদিও অলিম্পিকে মহিলাদের ম্যারাথন শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। ২০১৭ সালে, প্রথম মহিলা ম্যারাথন দৌঁড়ের ৫০ বছর পূর্তি হয়। ক্যাথারিন আবারও নামেন বোস্টন ম্যারাথনে সেই পুরোনো ২৬১ নাম্বার বিব পরেই। তবে এবারে আর তিনি একা ছিলেন না, তার সাথে স্টার্টিং লাইনে ছিলেন আরও ১২০০০ জন মহিলা প্রতিযোগী। তাই বলা যেতেই পারে, যদি নতুন কিছুতে বিশ্বাস রাখা যায়, সেটি করে দেখানোর চেষ্টা করে যেতে হয় অক্লান্ত পরিশ্রমে। প্রচুর বাধা বিপত্তি পার হয়ে সফল হলে বাকি দুনিয়াই সেই ধারণার সঙ্গে নিজেকে ‘অ্যাডজাস্ট’ করে নিতে বাধ্য হয়।
Discussion about this post