আমাদের দেশ স্বাধীন, সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক দেশ। এরমধ্যে একটি শব্দ আজ আলোচনার মধ্যমণি। ধর্মনিরপেক্ষ (Secular)। বিগত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরা সংবিধান থেকে এই শব্দকে বাদ দেওয়ার কথাও বলেছেন প্রকাশ্যে। যদিও, বাস্তবে সংবিধানের “মূল কাঠামো” তত্ত্ব (Basic Structure Doctrine) অনুযায়ী, ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) ভারতীয় সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুপ্রিম কোর্টও বহুবার বলেছে ধর্মনিরপেক্ষতা কোন সরকার ইচ্ছামতো সরাতে পারবে না। “সেক্যুলার” শব্দ সরাতে চাইলেও সেটি সহজ হবে না। কিন্তু, আজ এই সেক্যুলার শব্দটিই হয়ে উঠেছে আসামি। কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গি হামলার পর ডানপন্থী সরকারের অধিকাংশই দোষারোপ করেছেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে। তাঁদের মতে ইসলামমাত্রেই জঙ্গি, ইসলামমাত্রেই সন্ত্রাস। সেক্যুলারিজম এই সন্ত্রাসকেই মদত দেয়।
বাস্তবে কি তাইই? সাধারণ মানুষ কি বলেন? রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া আদপেই কী এক ধর্মের মানুষ, অন্য ধর্মের মানুষকে আক্রমণ করেন? রাজনৈতিক নেতারা, অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক দলের আইটি সেল অবশ্যই এই ন্যারেটিভ দিয়েই মানুষের মনকে বিষিয়ে তোলে, যে হিন্দুরা মুসলিমকে খতম করতে চায় অথবা মুসলিমমাত্রেই খুনি। কিন্তু বাস্তব কী বলছে?
কাশ্মীর ফেরৎ হিন্দু ট্যুরিস্টরা বলছেন, কিভাবে কাশ্মিরীরা তাঁদের সাহায্য করেছেন। কোনো সামরিকবাহিনী ছাড়া কিভাবে ঘটনাস্থল থেকে নিজেদের কাঁধে উঠিয়ে পর্যটকদের তাঁরা পাহাড় থেকে সমতলে নামিয়ে এনেছেন, হাসপাতাল পৌঁছে দিয়েছেন। কিভাবে আক্রমণের প্রতিবাদে গোটা জম্মু ও কাশ্মীরে বনধ হয়েছিল। ট্যুরিস্ট আরতি বলছেন “আমি কাশ্মীরে আমার দুজন ভাইকে পেয়েছি – মুসাফির এবং সামির”। মহারাষ্ট্রের এক পরিবার বলছে, “আমরা বেঁচে আছি, কারণ কাশ্মীরি এক ভাই তাঁর বাড়িতে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন”। হামলায় নিহত সুরাটের ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের স্ত্রী শীতল বলছেন, “Problem not with Kashmir, but our government’s security arrangements.” বিজেপি কর্মী অরবিন্দ আগরওয়াল স্থানীয় কাশ্মীরি গাইড নাজাকতকে তাঁর ও তাঁর পরিবারকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আক্রমণে নিহত কাশ্মীরি খচ্চরওয়ালা আদিল হুসেন শাহর পরিবার জানিয়েছে তাঁরা শুধু আদিলের জন্য নয়, নিহত সকল ভারতবাসীর জন্য কাঁদছেন।
২০০২ গোধরা দাঙ্গার সময় আহমেদাবাদের কিছু মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে মুসলিমরা হিন্দুদের নিজেদের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলেন। ২০১৭ সালে অমরনাথ যাত্রায় জঙ্গি হামলার পর বহু কাশ্মীরি মুসলিম বাসচালক, দোকানদার আহত তীর্থযাত্রীদের সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু এই বিষয়গুলি সম্প্রচার হয়না, সম্প্রচার হয় ঘৃণার বীজ। তাতে লাভ হয় কার, বা কাদের তা সকলের জানা। সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পরেও একইভাবে উঠে এসেছে মানবতার ছবি। ঘৃণা বা হিংসার থেকেও এই মানবতার ছবিগুলিই বেশি, এই মানবতার বার্তাই বদলে দিতে পারে জনমানসের মনকে। “মানুষ মানুষের জন্য” একথাই বারবার সত্যি হয়ে উঠতে পারে।
ছবি এঁকেছেনঃ ধৃতিমান ভট্টাচার্য্য
Discussion about this post