রাতের অন্ধকারে জ্বলছে মন্দিরের আঙিনা। ভস্মের গন্ধে ভারী বাতাস। ঢোলের তালে মিশে গেছে চিৎকার, “কালাপাহাড় এসেছে!” এককালে যে ছিল ব্রাহ্মণ পুরোহিত, আজ সে হিন্দু সমাজের চোখে সর্বনাশের প্রতীক। কালাপাহাড়! এই নাম উচ্চারণেই ভয় মিশে থাকে। অথচ কেউ জিজ্ঞেস করে না, কীভাবে দেবতার ভক্ত এক পুরুষ পরিণত হলো দেবালয় ভাঙা এক সেনাপতিতে? এ গল্প শুধুই ধর্মত্যাগের নয়; এ গল্প অপমান, প্রতিশোধ আর মানুষের নির্মম বিভাজনের।
ইতিহাস বলে, কালাপাহাড়ের জন্ম নাম ছিল মীধা বা রাজীবলোচন। সে ছিল এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ যুবক। কিন্তু প্রেম, অপমান ও সমাজের নিষ্ঠুর আচরণ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কথিত আছে, এক মুসলিম রাজকন্যার প্রেমে পড়ে সে সমাজচ্যুত হয়। ধর্মের রুদ্ধদ্বার ভেদ করতে না পেরে, জন্ম নিল অভিমানী মীধা ইসলাম। সেখান থেকেই তৈরি হল ‘কালাপাহাড়’! যার তলোয়ার পরে বহু মন্দিরের গম্বুজ কাঁপিয়েছিল।
কিন্তু প্রশ্ন উঠতেই পারে, কালাপাহাড় কি সত্যিই কেবল “ধর্মদ্রোহী”? নাকি সে আসলে ছিল এক মূর্তিমান প্রতীক! যে সমাজের ভণ্ডামি ও অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে নিজেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল? যেভাবে হিন্দু-মুসলিম রাজনীতির খেলায় ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, তেমনিই আদলে কালাপাহাড়ের নামও পরিণত হয়েছে ভয়ের প্রতীকে। মুসলিম শাসকদের “মন্দির ভাঙার দায়ে” যতটা ঘৃণা জন্মেছে, আড়ালে থেকেছে তার চেয়েও বেশি সামাজিক ভন্ডামি, নিষ্ঠুরতা; যা একজন মানুষকে দানবে পরিণত করতে পারে।
আজও অজান্তেই আমরা “কালাপাহাড়” নামটি উচ্চারণ করি ঘৃণার প্রতীক হিসেবে। কিন্তু ইতিহাসের আয়নায় দেখলে বোঝা যায়, তিনি ছিলেন মানবিক দুর্ভাগ্যের ফল, কোনো ধর্মের নয়। সমাজ যখন ভালোবাসাকে অপরাধ বানায়, যখন অপমান প্রতিশোধে রূপ নেয়, তখনই জন্ম হয় এমন চরিত্রের। কালাপাহাড় কেবল এক ব্যক্তি নন। তিনি আমাদের ইতিহাসের এক অন্ধকার ছায়া, যা আজও হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষের ভিতরেই ঘুরে বেড়ায়।






































Discussion about this post