ভারত উপমহাদেশের মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম মহিলা যিনি বিদেশ থেকে মেডিকেল ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসা রীতিতে চিকিৎসা করার অনুমতি পেয়েছিলেন। প্রথম নারী যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন। এরকমই কিছু একগুচ্ছ রেকর্ড রয়েছে যার ঝুলিতে সেই ডাঃ কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক।
ডাক্তারি পড়তে শুরু করার সময়েই বিপত্নীক দ্বারকানাথের সঙ্গে কাদম্বিনীর বিয়ে হয়। সেই সময় অধিকাংশ মেয়েই বিয়ের পর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারতেন না। কিন্তু কাদম্বিনীর ক্ষেত্রে একেবারেই তা হয়নি। মূলতঃ দ্বারকানাথের আগ্রহেই কাদম্বিনী পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। যে কারণে নানা কটু কথাও শুনতে হয়েছিল তাঁকে। দ্বারকানাথ ভারত-সভা এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দ্বারকানাথের স্ত্রী কাদম্বিনীর নেতৃত্বে প্রথম ছয় জন নারী কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে যোগ দেন। তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রথম নারী বক্তা ছিলেন। তিনি ছিলেন একে মহিলা, তার উপর অন্যের বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা! সেসময় একথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। এমনকি পাঁচ শিশু সন্তানের জন্ম দেয়ার পরও বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করতেন তিনি। তখনকার দিনে এরকমই নানা অসম্ভব বিষয়কে সম্ভব করে তুলেছিলেন কাদম্বিনী।
সেই সময় চা বাগানের শ্রমিকদের উপর ব্রিটিশ শোষণ চলত। আসামের চা বাগানের শ্রমিকদের কাজে লাগানোর পদ্ধতির তীব্র নিন্দা করেন কাদম্বিনী। শেষমেশ কবি কামিনী রায়ের সঙ্গে বিহার এবং ওড়িশার নারী শ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত করে তাঁকে। গৃহকর্মেও বেশ নিপুণা ছিলেন কাদম্বিনী। অবসর সময়ে বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ করতেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের মাঘী পূর্ণিমার প্রস্তুতিতে গানও শেখাতেন তিনি। স্বাবলম্বী, স্বাধীনচেতা কাদম্বিনী সবসময় কাজের মধ্যেই থাকতে চাইতেন। এমনকি তিনি মরতেও চেয়েছিলেন চিকিৎসা করতে করতেই। জীবনের শেষ দিনটাতেও কাদম্বিনী রোগীর বাড়ি গিয়ে জটিল অস্ত্রোপচার করেছিলেন। বাড়ি এসে পুত্রবধুকে বলেছিলেন, সেই দিনটা তাঁর সার্থক হল। তাঁর এত ভাল লাগছিল যে তিনি শূন্যে উড়ে বেড়াতে চাইছিলেন। পুত্রবধূর সাথে কথা বলার কিছুক্ষণ পরই স্নান করতে গিয়ে কঠিন সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান কাদম্বিনী। মারা যাওয়ার পর তাঁর ব্যাগ থেকে বের হয়েছিল পঞ্চাশটি টাকা, যা ছিল তাঁর শেষ রোজগার।
তাঁর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ ডেভিড কফ লিখেছিলেন, “কাদম্বিনী ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে স্বাধীন ব্রাহ্ম নারী। তৎকালীন বাঙালি সমাজের অন্যান্য ব্রাহ্ম এবং খ্রিস্টান নারীদের চেয়েও তিনি অগ্রবর্তী ছিলেন।” যথার্থই লিখেছিলেন তিনি! কাদম্বিনী বসু আসলে আমাদের এই শিক্ষাই দিয়ে গেছিলেন, ভারতীয় নারীরা আসলে সত্যিই অবলা নয়। তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য কোনও পুরুষের সাহায্য লাগে না। তাঁরা হয়ত সারা জীবন নীরবই থেকে যান কিন্তু প্রয়োজনে বহ্নিশিখার মত জ্বলেও উঠতে পারেন।
Discussion about this post