সময়টা আঠেরো শতকের মাঝামাঝি। কোম্পানির আধিপত্য ক্রমশই বেড়ে চলেছে। নদীয়ার সিংহাসনে তখন বিরাজমান মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র মহারাজ গিরীশচন্দ্র। রাজধর্মের পরিবর্তে আধ্যাত্মিক দিকেই তার প্রবল আগ্রহ ছিল। ফলে তার রাজত্ব দেখভালের দায়িত্ব পড়ে রাজ-কর্মচারীদের ওপর। তবে কিছু দিন ঠিক মত চললেও সমস্যা শুরু হতে বেশিদিন সময় লাগেনি। সঠিক সময়ে কোম্পানির ঘরে খাজনা জমা না পড়ায় নিলামে উঠল তৎকালীন নদিয়ার উখড়া পরগনা। উখড়ার উত্তর দিক নিলামে কিনে নিলেন কলকাতার জমিদার মধুসূদন সান্যাল ও দক্ষিণ দিক কিনলেন কাশীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।নবদ্বীপ ছিল উত্তর উখড়ার অন্তর্গত।
সালটা ১৮৫২। জমিদার মধুসূদন সান্যাল পারলেন না বেশিদিন তার কেনা জমিদারি টিকিয়ে রাখতে। তিনি বিক্রি করে দিলেন জমিদারি। শ্রীচন্দ্র,তৎকালীন নদীয়ার রাজা খবর পেয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন উখড়ার যে অংশের অন্তর্গত নবদ্বীপ সেটি নিজের অধীনে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে। কারণ সেই সময় নদিয়া রাজ ‘নবদ্বীপাধিপতি’ উপাধিপ্রাপ্ত ছিলেন। কিন্তু তার রাজত্বের মধ্যে নবদ্বীপই যদি না থাকে, তাহলে সেই উপাধি তো অর্থহীন। কিন্ত বহু চেষ্টার পরেও শ্রীচন্দ্র নবদ্বীপের জমিদারি নিজের দখলে আনতে পারেননি। কারণ সেই জমিদারী কিনতে উদ্যোগী হয়েছিলেন সকলের রাণী মা।
নবদ্বীপের জমিদারি সংক্রান্ত কাজকর্ম পরিচালনার জন্য রানি মায়ের হাত ধরে নবদ্বীপের গঙ্গার ধারে গড়ে ওঠে কাছারি বাড়ি। সুবিশাল প্রবেশ দ্বার,ভিতরে আছে রাসমণি সেবিত রাধাগোবিন্দ জিউ ও গৌরাঙ্গ জিউর মন্দির। বাড়ির ভিতর দিয়ে ধার বেয়ে নেমে গিয়েছে বাঁধানো সিঁড়ির ঘাট। গঙ্গা দিয়ে নৌকায় এসে ওই ঘাটের সিঁড়ি দিয়েই কাছারি বাড়িতে আসতেন রাণী রাসমণি। রাণী মা নবদ্বীপে এলে স্নান করতে যেতেন কাছারি বাড়ির নিকটবর্তী নবদ্বীপের সুপ্রাচীন একটি ঘাটে। পরবর্তীতে রানি রাসমণির নামে সেই ঘাটটির নামকরণ করা হয় ‘রাণীর ঘাট’। জনশ্রুতি বলছে, রাণী রাসমণির সঙ্গে নবদ্বীপের যোগাযোগ যথেষ্ট গভীর। জানা গিয়েছে, দক্ষিণেশ্বর মন্দির উদ্বোধনের সময় তাতে যোগদানের জন্য নবদ্বীপের বৈষ্ণবদের আহ্বান জানান রাসমণি দেবী।
আজও নবদ্বীপের গোকুলানন্দ ঘাট রোডে আছে এই কাছারি বাড়ি। বৃন্দাবন গোস্বামীর মৃত্যুর পরে রাণী রাসমণির কাছারি বাড়ির কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন প্রায় ফাঁকাই থাকে সুবিশাল বাড়িটি। স্থানীয় নাগরিকদের মতে, এই কাছারি বাড়ি এবং সেই বাড়ির ঘাট উভয়েরই রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। তবেই তা থাকবে ভবিষ্যতের জন্য। আপনি যদি নবদ্বীপ আসার পরিকল্পনা করে থাকেন, তালিকাতে জুড়ে নিন রাণী মায়ের কাছারি বাড়ি।
Discussion about this post