বাংলা লোকসঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারা হল ‘কবিগান’। যেখানে দুটি দলের মধ্যে ছন্দ মিলিয়ে গানের লড়াই চলে। ১৭৬০-এর পর থেকেই এই কবিগানের বিকাশ হতে থাকে।তখন এই লড়াইয়ে একে অপরকে প্রশ্ন-উত্তরে ঘায়েল করার সময় ভাষা নির্বাচনের শালীনতা একেবারেই মাথায় রাখা হতো না। যার ফলে কবিগানে নানাভাবে অশ্লীলতার ও স্থূল আদিরসের প্রভাবই বেশি দেখা যেত। সেসময় অনেকেই একে ‘অশিক্ষিত মূর্খদের গান’ বলতেন। তখন বাংলার এক কবিয়াল বাংলা কবিগানে রেনেসাঁ নিয়ে আসেন, শুরু করেন কবিগানের সংস্কারের কাজ। যার নাম বিজয় সরকার। দুই-বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে গান গাইতেন বলে তিনি নিজেকে চারণকবিও বলেছেন। বাংলা লোকসঙ্গীতে অবদানের জন্য ‘কবিয়াল’ হিসেবে বিজয় সরকার ২০১৩ সালে বাংলাদেশের মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ পান।
বিজয় সরকার (ফেব্রুয়ারি ২০,১৯০৩ – ডিসেম্বর ৪,১৯৮৫) বা পাগলা বিজয়-এর জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের নড়াইলের ডুমদী গ্রামে। খুব ছোটো বয়স থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর বহু শিক্ষকদের কাছ থেকে তিনি গান শিখেছেন। তারপর ১৯২৫ সালে গোপালগঞ্জের কবিয়াল মনোহর সরকারের কাছে তাঁর কবিগানের তালিম।নিজের লেখা একটি গান গেয়েই তিনি তাঁর গুরুর মন জয় করেন। ১৯২৯ সাল নাগাদ তিনি চালু করলেন নিজের গানের দল। তিনি মূলত দুটি ধারার গানই বেশি গাইতেন- কবিগান ও রামায়নের গান। তবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পান ভাটিয়ালি সুরের ওপর ভিত্তি করে তার নিজের লেখা ‘ধুয়া’ গানের জন্য। তাঁর রচনা করা ‘সখি সংবাদ’ ও ‘ধুয়া’ গানের সংখ্যা প্রায় চারশো-র কাছাকাছি। ভাটিয়ালি সুরের সঙ্গে বাউলসঙ্গীতের অন্তর্ধর্মকে মিশিয়ে বাংলা লোকসঙ্গীতের আঙিনায় এক নতুন ঘরানা উপহার দিয়েছেন বিজয় সরকার। লোকসঙ্গীতের এই বিশেষধারাকে কেউ কেউ ‘বিচ্ছেদ ভাটিয়ালি’ বলে থাকেন। আবার কেউ এই গানগুলি কে বলেন ‘বিজয়গীতি’।
বিজয় সরকারের গানে মূলত বিচ্ছেদ বেদনা, হাহাকারের কথা ফুটে ওঠে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে বিজয় সরকারের গান মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। বাংলার মাঠ-ঘাট, খামার, ধানক্ষেত সব জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁর জীবন দর্শন, তাঁর গান। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য পেয়েছেন বলে শোনা যায়। তাঁদের গানকে অনুসরণ করে সহজ ভাষায় গান লিখে গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে পৌঁছে দেন। তাঁর প্রিয়- বিচ্ছেদের গান “তুমি জানোনারে প্রিয় তুমি মোর জীবনের সাধনা” আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। জসীমউদ্দিনের ‘নকশিকাঁথার মাঠ’-এর রূপাই -সাজুকে অবলম্বন করে লিখেছিলেন- “নকশি কাঁথার মাঠে সাজুর ব্যথায় আজো যে বাজে রূপাই মিয়ার বাঁশি।” তিনি জীবন এবং চারপাশে থেকেই তাঁর গানের অনুপ্রেরণা পেতেন।
তাঁর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর শেষকৃত্য সেরে ফেরার পথেই রচনা করেন – “আমার পোষা পাখি উড়ে যাবে প্রাণ সজনী একদিন ভাবি নাই মনে।” তাঁর গান বা জীবনে ধর্মীয় গোঁড়ামি কখনই ছিল না। তাঁর গান – “জাতি বলতে কী বুঝলেন পন্ডিত মশাই/ দেখি জগতে এক মানবজাতি দুইভাগে বিভক্ত তাই” সেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথাই বলে। তিনি কৃষ্ণ প্রেমের গানও যেমন রচনা করেন, সমানভাবেই রচনা করেছেন ইসলামী গান। যে কোনো ভাষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সেই ভাষার গান বিরাট ভূমিকা পালন করে। তেমনি বাংলা গান, বিশেষত বাংলা লোকগান বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের আঞ্চলিক ভাষা-সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। বিজয় সরকার তেমনি একজন লোকশিল্পী ছিলেন যার লেখা গানে উঠে এসেছিল নদীমাতৃক বাংলার মাঝি-মল্লাদের ‘ভাটিয়ালি’ গানের সুর, কৃষ্ণ প্রেম, প্রকৃতি, জীবনযাপন, সাধারণের দুঃখ-বেদনা। জীবনের চরম সত্যটিকে গানে গানে বেঁধেছিলেন – “এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি রবে/ এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে।” বাংলা ভাষা, বাংলা সঙ্গীতকে এতোকিছু দেওয়ার পরেও এই ‘সুন্দর পৃথিবী’ বিজয় সরকারকে তার প্রাপ্য স্বীকৃতি কতটুকু দিলো? সে প্রশ্ন বোধহয় থেকেই যায়।
Discussion about this post