তেলমাখা একটি বাঁশ। তাতে একটা বাঁদর উঠছে এবং নামছে। অথবা একটা ফুটো চৌবাচ্চা। তার একদিক দিয়ে জল ঢুকছে, অন্যদিক দিয়ে বেরোচ্ছে। স্টেশনের সেই ট্রেনটির কথাই ধরা যাক নাহ। প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এতটাই লম্বা সে। তার সঙ্গে যুক্ত হত তার গতিবেগ। আবার কখনও চক্রবৃদ্ধি সুদে বাড়ছে কোনও জিনিসের দাম। কি মনে পড়ছে কিছু? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। সেই স্কুল জীবনের পাটিগণিতের অঙ্ক। যার ভয় এবং চিন্তায় কেটে গেল আমাদের পুরো শৈশব। কৈশোরেও পিছু ছাড়েনি সে। অঙ্কের ক্লাসে পাটিগণিত মানেই তখন সে এক দুঃস্বপ্ন! স্কুল পেরিয়েও বা ভুলতে পারলাম কই। মধ্যবয়সী কাজের চাপে এখনও ঘুরে ফিরে আসে সেই ভাবনা। একটা পুরো ছেলেবেলা কেটে গেল যার হাত ধরে তিনি আর কেউ নন, পাটিগণিতের ‘নতুন’ জন্মদাতা কে সি নাগ ওরফে কেশব চন্দ্র নাগ।
১৮৯৩ সালের হুগলীর গুড়াপের নাগপাড়ায় আজকের দিনেই জন্ম তাঁর। শৈশব কাটিয়ে বিদ্যালয়ের গন্ডী পেরিয়ে ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগে আই এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর পালা উচ্চশিক্ষার। তার সঙ্গেই চলতে লাগল শিক্ষকতাও। অঙ্ক, সংস্কৃত এবং কলাবিদ্যা, এই তিন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন তিনি। এরপর কিষেণগঞ্জ বিদ্যালয়ে অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন তিনি। সেই সময় থেকেই চারিদিকে তাঁর পড়ানোর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। একসময় বহরমপুর কলেজিয়েট স্কুলেও অঙ্কের মাস্টারমশাই হিসাবে শিক্ষাদান করেছিলেন তিনি। এরপর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাকে কলকাতায় নিয়ে এলে, ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিশনের অঙ্কের শিক্ষার দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর। আজীবন এরপর এই ইন্সটিটিউশনেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এমনকি প্রধান শিক্ষক হিসাবে এই স্কুল থেকেই শেষ অবধি অবসরও নেন।
সারাজীবন শিক্ষকতার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি। অঙ্ক নিয়ে বসলে তিনি যেন মগ্নই হয়ে যেতেন। অন্য কোনও কথা তখন মাথাতেও থাকত না। কলকাতায় থাকাকালীন কবি কালিদাস রায়ের বাড়িতে সান্ধ্য আড্ডায় প্রায় প্রতিদিনই দেখা মিলত তাঁর। মূলতঃ তাঁর উৎসাহেই এরপর অঙ্কের বই লেখা শুরু কেশব নাগের। তিনের দশকের মাঝামাঝি এরপর প্রকাশিত হয় কেশব নাগের লেখা ‘নব পাটিগণিত’। সাদা-কালোয় ছাপা এক অঙ্কের বই, যার পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে অঙ্ককে ভালবাসার চিহ্ন। প্রকাশ করা মাত্রই জনপ্রিয় হয়ে উঠল এই বই। শিক্ষক থেকে ছাত্র, সব্বার প্রথম পছন্দ তখন কেসি নাগের পাটিগণিত। অবশ্য হবে নাই বা কেন! এত সহজ, প্রাঞ্জল ভাষায় বোঝানো এবং লেখা অঙ্কের বই আগে এত সহজে তো মেলেনি কখনও। ১৯৪২ সালে কেসি নাগ বের করলেন ম্যাট্রিকের অঙ্কের বই। সেটিরও চাহিদা উঠল তুঙ্গে। এরপর বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর লেখা অঙ্কের বইগুলি।
তাঁর চরিত্রের একটি দিক হয়ত এখনও অন্ধকারের পর্দায় ঢাকাই রয়ে গেছিল। শুধু বই লেখা বা শিক্ষকতাই নয়। কেশব চন্দ্র সামিল হয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও। একসময় সক্রিয় বিপ্লবী হিসাবে তাঁর বেশ নাম ছিল। গান্ধীজির ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হয়ে তিনি জেলও খাটেন বেশ কিছুদিন। সেই সময় ম্যালেরিয়ায় ভুগছেন তিনি। তবু বিপ্লবী মনোভাবকে দমিয়ে রাখা যায়নি তাঁর। ভোটে দাঁড়ানোর প্রস্তাব এলেও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সযত্নেই।
তাঁর মৃত্যুও এসেছিল আচমকা। নিজের অবসরের পছন্দের হাত ধরেই। ক্রিকেট খেলা খুব পছন্দ করতেন তিনি। মাঠে গিয়ে খেলা দেখতে না পারলে রেডিওতে শুনতেন তার ধারাবিবরণী। সেই ধারাবিবরণী শুনতে শুনতেই একদিন মস্তিষ্কের ভিতরে রক্তক্ষরণ শুরু। ডাক্তারি ভাষায় যার নাম, ‘ইন্টারনাল হেমারেজ’। ১৯৮৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি। শেষ হল যার অঙ্ক কষা। জীবনের পাটিগণিতের শেষ চ্যাপ্টার এভাবেই লেখা হল তাঁর। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা গেলেন তিনি। রেখে গেলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রঞ্জিত মল্লিকের মত কিছু দিকপাল ছাত্রকে। তবে তিনি চলে গেলেও তাঁর লেখা বইয়ের চাহিদা কিন্তু এতটুকুও কমেনি। এখনও তাঁর বই বিক্রির সমস্ত টাকা চলে যায় তাঁর এবং স্ত্রী লক্ষ্মী দেবীর নামে বানানো ফান্ডে। সাদা-কালো অক্ষরে ছাপা সেই অঙ্কের বইটির জন্মদাতাতে এখন প্রায় ভুলতেই বসেছে মানুষ। তাঁর জন্মদিনে না হয় কোনও ধুমধাম, না কোনও স্মরণ সভা। গুড়াপে তাঁর জন্মস্থানে প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালেই প্রতি বছর পালিত হয় তাঁর জন্মদিবস। আমাদের শৈশবের শিক্ষা যাঁর হাত ধরে তাঁকে কি এতই সহজে ভুলে যাব আমরা? আগামী প্রজন্ম কি জানবে না তাঁর নাম? কে জানে! হয়ত সময়ই দিতে পারে এর উত্তর।
Discussion about this post