একসময় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির পাশাপাশি পুজোয় সমান পাল্লা দিত জোড়াসাঁকোরই আরেকটি বনেদি পরিবার, দাঁ পরিবার। উত্তর কলকাতার নামকরা সেই বনেদি পুজোর শুরু যার হাত ধরে, তিনি ছিলেন আসলে সেই পরিবারেরই এক পোষ্যপুত্র। তিনিই বরণ করে আনেন মাকে। ১৮৪০ সালে গোকুলচন্দ্র দাঁ নিজের পুত্র হিসাবে দত্তক নেন শিবকৃষ্ণ দাঁ-কে। সে বছর শিবকৃষ্ণই প্রথম দাঁ পরিবারে শুরু করেন মায়ের আরাধনা। আর সেই পুজোরই জৌলুসের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারও।
শিবকৃষ্ণ দাঁর সময়কালে পারিবারিক ব্যবসায় প্রভূত লাভের মুখ দেখে দাঁ পরিবার। সেই লাভের টাকাতেই ‘মা’কে নিজের পরিবারে নিয়ে আসেন শিবকৃষ্ণ বাবু। তিনি নিজে যেমন সাজগোজ করতে বিশেষ পছন্দ করতেন; তেমনই সিদ্ধান্ত নিলেন দেবী দুর্গাকেও তিনি সুন্দর অলঙ্কারে সাজাবেন। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ! তাঁর আদেশে দেবী প্রতিমার জন্য ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে বিশেষ কাজ করা অলঙ্কার এবং পোশাকও আনানো হয়। পোশাকে ছিল সোনালি রুপোলী জরির কাজ এবং বেশ দামি কিছু পাথর। তৎকালীন আমলে কলকাতার কেউ আর ওমনটা দেখেনইনি! লোকমুখে শোনা যায়, সে সময় দেবী মর্ত্যে এসে প্রথমেই দাঁ বাড়ির সেই পোশাক এবং অলঙ্কারে নিজেকে ভূষিত করতেন। তারপর অন্যান্য স্থানে যেতেন। এমনকি আজও সে কথাই প্রচলিত।
এখনও সেই পোশাকেই দেবীকে বরণ করেন দাঁ পরিবার। প্রতিমার চালচিত্রে ব্যবহৃত হয় তামা ও পিতল দিয়ে তৈরি একরকম ধাতুর পাত। সেটিরও প্রবেশ শিবকৃষ্ণ বাবুরই হাত ধরে৷ এছাড়াও বোধনের দিন গাঢ় মোলায়েম ভেলভেটের তৈরি, সোনা-রূপোর জরির কাজ করা একটি ছাতা নিয়ে কলাবৌকে নিয়ে যাওয়া হয় স্নানের জন্য। এ বাড়িতে পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিনদিনই হয় কুমারী পুজো। তবে এই পরিবারে বলি নিষিদ্ধ। দেওয়া হয় না অন্ন ভোগও। নৈবেদ্য হিসাবে লুচি, তরকারি এবং মিষ্টি দিয়ে ভোগ দেওয়া হয় মাকে। কঠোর শাস্ত্রীয় বিধি অনুসরণ করেই সম্পন্ন করা হয় দাঁ পরিবারের এই পুজো।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে দাঁ পরিবারের রেষারেষি চলত এক্কেবারে সেয়ানে-সেয়ানে। এই নিয়ে বেশ মজার এক গল্পও লোকমুখে বিশেষ প্রচলিত। তা হল- বিজয়া দশমীর দিন প্রায় ৪০ জন বাহক দেবীকে কাঁধে করে বিসর্জনে নিয়ে যেতেন। তবে গঙ্গায় পৌঁছনোর আগেই তাঁরা ঠাকুরবাড়ির সামনে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে দেবীকে বেশ কয়েকবার ঘোরাতেন। তারপর যেতেন বিসর্জনে। তবে সময়ের সঙ্গে কবেকার সেই প্রথাও যেন আজ কোথায় হারিয়েই গিয়েছে। বর্তমানে বাহকের কাঁধে নয়, দেবীকে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় লরিতে। বহুকাল আগের পুজোর সেই জৌলুসও আজ অনেকাংশেই বেশ ম্লান। তবুও অতীতের ঐতিহ্যে ভর করেই জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ির পুজো তিলোত্তমার অন্যতম বনেদি পুজোর শিরোপা নিয়েই হয়ে চলেছে আজও।
চিত্র ঋণ – শিপ্রা হালদার এবং অভিজিৎ দাস
Discussion about this post