‘কুন্ডলিকা’ কখনো চেখে দেখেছেন? অথবা যদি বলা হয় ‘জলবাল্লিকা’। ধরা যাচ্ছে না তো? “নিখুঁতি জিলিপি গজা ছানাবড়া বড় মজা। শুনে সক্ সক্ করে নোলা।” এই তো একদম সঠিক। জিলিপিরই কথা হচ্ছে এখানে। জিলিপির সংস্কৃত নাম ‘সুধা কুন্ডলিকা’ কিংবা ‘জলবাল্লিকা’। ওপরের লেখাটি রামনারায়ণ তর্করত্নের হলেও সমস্ত ভারতীয়দের জন্যই তা প্রযোজ্য। একমাত্র এই আড়াই প্যাঁচের প্রেমে পড়েছে সমগ্র ভূ-ভারত। পড়বে নাই বা কেন? এমন মুচমুচে-রসালো জুটি তো আর অন্য মিষ্টিতে পাওয়া দুষ্কর। তবে জিলিপির সৃষ্টি কিন্তু ভারতবর্ষে নয়।
মিশরের ১৩০০ শতাব্দীর আগেই নাকি জন্ম নেয় এই মিষ্টি। মধ্যযুগে তুর্কিরা এই মিষ্টিকে প্রথম ভারতবর্ষে নিয়ে আসে। ‘জিলিপি’ কথাটির উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘জুলাবিয়া’ কিংবা ফারসি শব্দ ‘জলবিয়া’ থেকে। শোনা যায়, মুঘল সম্রাটদেরও প্রিয় ছিল এই মিষ্টি। ক্রমে সাধারণ ভারতীয়দের প্রিয় মিষ্টির তালিকায় ঢুকে পড়ে ‘জিলিপি’ যাকে হিন্দিতে ‘জালেবি’ ও বলা হয়। এ দেশে নানা বৈচিত্র্য থাকলেও কিন্তু সর্বত্র মিলবে এই মিষ্টি। সেই মুঘল আমল থেকে এখনও পর্যন্ত একই পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় জিলিপি। যার জন্য ‘জিলিপি’কে ভারতবর্ষের জাতীয় মিষ্টির তকমা দেওয়া হয়েছে। তবে জিলিপির কথা হচ্ছে যখন, কোচবিহারের জিলিপি কী করে বাদ দেওয়া যায়।
জিলিপি তৈরি হয় ময়দা,চালের গুঁড়ো দিয়ে। আর অমৃতির মূল উপাদান কলাই ডালের গুঁড়ো। আরও সুস্বাদু বানাবার জন্য এর উপকরণে দেওয়া হয় ঘি, এলাচ এমনকি জাফরান! কোচবিহার জেলার ভেটাগুড়ির জিলিপি! রথযাত্রায় মুচমুচে এই মিষ্টি খাওয়া শুরু করলে তা শেষ হবে একেবারে রাসমেলায়! এমনই চাহিদা এখানকার জিলিপির। দোকানে মিষ্টি নিমেষে শেষ হয়ে যায়, ফলে স্থানীয়দেরই হাতে পৌঁছয় না অনেক সময়। পাঁচের দশকে ভেটাগুড়িতে মিষ্টির দোকান খুলছিলেন বিধুভূষণ নন্দীবাবু। তারপরই শুরু হয় এই জিলিপি যাত্রা। রাসমেলাতেও নিয়মিত দোকান দিতেন। বর্তমানে উত্তরসূরিরা ভিন্ন পেশায় যাওয়ায়, সেই দোকান আর নেই। তবে প্রতি বৎসর মেলা আসার আগে মিষ্টি নির্মাতারা এই দোকান চালানোর বায়না নিতে তাঁদের বাড়ি চলে আসেন। এখনো সেখানে মেনে চলা হয় বিধুবাবুর পুরনো ফর্মুলা। কারিগররা সেই জিলিপির রস তৈরীর পদ্ধতিও বলেন না কাউকে। শুধু আকৃতিতে নয়, জিলিপি তৈরীর আসল প্যাঁচ এখনো তাদের হাতেই। ঘি-ময়দা-চালের গুঁড়োর অনুপাত ঠিকঠাক থাকলে তবেই মুচমুচে জিলিপি তৈরি করা যায়। “হোক না যতই আড়াই প্যাঁচ, মিষ্টতা তো আছে!” এই প্যাঁচে পা দিতে কোনো দোষ নেই। তাহলে আর দেরি কিসের? বর্ষা কিন্তু এখনো পেরোয়নি, হয়ে যাক একদিন গরম গরম মুচমুচে জিলিপি।
চিত্র ঋণ – জয়ন্ত চক্রবর্তী, তমাল ঘোষ
Discussion about this post