মাস্টারদার ডাকে ৬৫ জন যুবক এককাট্টা, ওই অত্যাচারী ব্রিটিশদের কবল থেকে স্বাধীন করতেই হবে চট্টগ্রামকে। তাদের মাটিতে পতপতিয়ে উড়বে ভারতের পতাকা, আর এর জন্য জান দিতেও প্রস্তুত তাঁরা। দিনটি ছিল ১৯৩০-এর ১৮ এপ্রিল, রাত দশটা। চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনের প্রহরী পুলিশটি দেখল গেটের দিকে এগিয়ে আসছে সামরিক উর্দিধারী দু’জন, খানিক পেছনে আরও জনা চারেক। ব্যস, তারপর ইংরেজদের ডেরায় ধ্বনিত হতে থাকল, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, বন্দেমাতরম।
বিপ্লবীদের সেই তেজ এবং হুঙ্কারে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল ইংরেজ পুলিশ বাহিনীর। পরিকল্পনামাফিকই চলছে কাজ। অন্যদিকে চট্টগ্রামের টেলিফোন ও টেলিগ্রাম অফিসে হামলা চালাতে গিয়ে হঠাৎ বিপাকে পড়েন বিপ্লবী হিমাংশু রায়। অফিসে আগুন দিতে গিয়ে কখন যেন তার গায়েও পড়েছে পেট্রোল আর জ্বলে উঠেছেন তিনিও। একদিকে সারা চট্টগ্রাম জুড়েই চলছে বিপ্লবীদের মাটি দখলের সশস্ত্র লড়াই। এমন সময় আলাদা হওয়া যে বিপদের, কিন্তু উপায় কী? তাই এসবের তোয়াক্কা না করেই দুই সেনানায়ক গনেশ ঘোষ আর অনন্ত সিংহ হিমাংশুকে মোটরগাড়িতে তুলে রওনা দিলেন শহরের দিকে, সাথে গেলেন আনন্দ গুপ্ত এবং জীবন ঘোষাল। তবে এই যে তারা বিচ্ছিন্ন হল, আর তাদের ফেরা হল না মূল দলে।
এদিকে ২২ এপ্রিল, ১৯৩০ জালালাবাদ যুদ্ধ শেষ। কিন্তু কোথায় ওই ৫ বিপ্লবী? ততক্ষণে চট্টগ্রাম লড়াইয়ের ঘটনা সকলের মুখে মুখে। এদিকে চট্টগ্রাম থেকে ৮ মাইল দূরে পুটিয়ারী রেলস্টেশনে হঠাৎ সন্দেহ হল এক সুদর্শন যুবকের কথায়। খবর পৌঁছে গেল যথা স্থানে। ফের হাতে রিভলবার তুলে নিলেন বিপ্লবীরা, কোনও ক্রমে পালিয়ে তারা আশ্রয় নিলেন চন্দনগরে তাদের তথাকথিত দাদা-বৌদির বাড়িতে। তারা রণ-ক্লান্ত, তারা পরিশ্রান্ত। এবার তারা পণ করেছেন আর পালাবেন না, হয় মারবেন নয় মরবেন।
ব্রিটিশ পুলিশের কানে খবর পৌঁছাতে দেরী হল না। ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩০ চন্দননগরের বাড়িটি কেঁপে উঠছে পুলিশের বুটের শব্দে। পুলিশ কমিশনার টের্গাট খোদ এসেছেন আজ। গণেশ ঘোষ বুঝলেন সময় শেষ। পেছনের দরজা দিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তেই পালাতে হবে। ওরা বেরোতেই পুলিশের গুলিবর্ষণ শুরু। নিমেষে ঝাঁঝরা হয়ে গেলেন জীবন ঘোষাল ওরফে মাখনলাল, ছিটকে পড়লেন পুকুরে। বাকিদের ওপরেও চলল ব্রিটিশ পুলিশের অকথ্য নির্যাতন, রেহাই পেলেননা মা-বোনেরাও।
শিগগিরই শেষ হল এই অসম লড়াই। পুকুরের জল থেকে তুলে আনা হল শহীদ বিপ্লবী জীবন ঘোষালের মরদেহ। চন্দননগরের পুলিশকে সেই দেহ স্পর্শ করতে দেয়নি শহরবাসী। চারুচন্দ্রের নেতৃত্বে জীবনের দেহ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় চন্দননগর মহা শ্মশানে। মাত্র ১৮ এর এক যুবককে সেইদিনই যোগ্য সম্মান জানায় চন্দননগরবাসী। একটা চট্টগ্রাম দিয়ে হয়ত সমগ্র ইংরেজদের দেশ ছাড়া করা যায়নি, তবুও জেদি আপোষহীন ওই চোখ গুলো আরও অনেক বিপ্লবীকে চোয়াল শক্ত করতে,শিখিয়েছিল, শিখিয়েছিল মুষ্ঠিবদ্ধ হাতটা আকাশে তুলে দিয়ে নিজের দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে।
Discussion about this post