অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি সিনেমা তো সবার দেখা। এই সিনেমার কবিগানের দৃশ্যে আমরা এক রাজবাড়ির মন্দিরকোঠা দেখেছিলাম। সেই মন্দির প্রাঙ্গণ আজও দেখা যায় পশ্চিম মেদিনীপুরের জাড়াগ্রামে। সিনেমার চরিত্র হিসেবে ভোলা কবিয়ালকে নিশ্চয় মনে আছে। এই ভোলা কবিয়াল চরিত্র টি তৈরি হয়েছিল ভোলা ময়রা কে কেন্দ্র করে। তিনি কিন্তু সত্যিই একজন কবিয়াল ছিলেন। একবার তিনি এসেছিলেন জাড়াগ্রামে। কবিগানের লড়াই লড়তে। প্রতিযোগী ছিলেন স্থানীয় কবিয়াল। যজ্ঞেশ্বর ধোপা। লড়াইতে ভোলা কবিয়াল বেশ একখানা গান বাঁধেন। গানটি হল, “কেমন করে বললি জগা/ জাড়া গোলোক বৃন্দাবন/এখানে বামুন রাজা চাষা প্রজা/ চৌদিকে তার বাঁশের বন।” লাইনগুলোয় ব্যাঙ্গাত্মক শ্লেষ ছিল বেশ। কিন্তু জাড়া রাজবাড়ির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে এ গান।
তৎকালে জাড়া রাজবাড়ির সুনাম ছিল সর্বজনবিদিত। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়,বর্ধমানের জনৈক ব্রাহ্মণ জমিদার একবার জাড়া গ্রামে আসেন। জমিদারী রক্ষার কাজ নিয়ে। ক্রমে রাজস্ব আদায় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এই গ্রাম আয়বর্ধক হয়ে ওঠে। পাকাপাকিভাবে তিনি মেদিনীপুরেই থেকে যাওয়ার কথা ভাবেন। কুলদেবতা গোপাল ঠাকুরের মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করেন এখানে। গাঙ্গুলী পদবী ছিল এই ব্রাহ্মণ বংশজাত জমিদারের। পরবর্তীতে নিজের কাজের দ্বারা রায়বাহাদুর উপাধি পান তিনি। এরপর নিজেকে রামগোপাল রায় হিসেবেই পরিচয় দিতে থাকেন। তিনিই প্রথম কালীপুজো প্রবর্তন করেন। ১১৫৫ বঙ্গাব্দে স্বহস্তে দুর্গামন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর পুত্র ছিলেন রাজীবলোচন রায়। তিনি এই বংশের গৌরবকে আরো মহিমান্বিত করে তোলেন। রাজীবলোচনের আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ একসময় ১৪ লাখ টাকা ছুঁয়েছিল। তিনিই বড়লাটের থেকে রাজা উপাধি পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পিতৃপ্রতিষ্ঠিত নাটমন্দিরে দুর্গাপুজোর প্রচলন তিনিই করেন। তাঁর আমলেই এই পুজোর আড়ম্বরের কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
অতিপ্রাচীন, প্রায় দুশো বছরের পুরোনো এই দুর্গাপুজো এখনো হয়। যে মন্দিরে পুজো দেখতে আসতেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে রাজবাড়ির আত্মীয় রাজা রামমোহন রায়। সেই মন্দির প্রাঙ্গণ আজও উন্মুক্ত থাকে সর্বসাধারণের জন্য। এখনও পুজোর মূর্তি তৈরী হয় মন্দির প্রাঙ্গণে। স্থানীয় মৃৎশিল্পীর হাতে। বলিনিষিদ্ধ এই পুজোয় প্রায় সতেরো রকম ভোগ আজও হয়। মহাষ্টমীতে নরনারায়ন সেবা হয়। মহানবমীতে প্রাচীন রীতি মেনে পরিবারের সকলে একত্রে বসেন। তারপর পঁচিশরকম পদ সহযোগে খাওয়া দাওয়া করেন তাঁরা। সন্ধিপুজোর সিঁদুরখেলায় আসে অগণিত দর্শনার্থী। প্রতিমা নিরঞ্জনের পর রাজবাড়ির ছাপান্ন কর্তার পরিবার একত্রে নজরুলগীতি গাইতে গাইতে ঘরে ফেরেন। নাটমন্দিরে দুর্গাপুজো শেষ হলে শুরু হয় কালীপুজোর প্রস্তুতি।
রাজবাড়ির ভগ্নপ্রায় স্থাপত্যে জেগে আছে ইতিহাস। তাতে মিশে বিষ্ণুপুরী ঘরানা ও ব্রিটিশ স্থাপত্যের মিশেল। ফাটল ধরা, আধভাঙা, শ্যাওলা পড়া দালানকোঠা তার। দেখলে কে বলবে এককালে রাজমহিষীর চুড়ির শব্দে মুখরিত থাকতো সে? কোঠাবাড়ির প্রতিটি ইট, আজও বয়ে চলেছে বাবুয়ানির হিসেব- রাজবংশের প্রাচীনত্ব। দু’শো বছর ধরে জমে উঠেছে কতই না ঐতিহাসিক চুপকথা।
Discussion about this post