ছোটবেলায় কমিকসের পাতায় পড়া টারজানের কথা মনে পড়ে? সেই যে জঙ্গলে বেড়ে ওঠা নাম না জানা সেই শিশু? জঙ্গলকে ভালোবেসে, জঙ্গল বাঁচাতে জীবনের প্রতিটা মূহুর্ত ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েও হাল ছাড়েনি যে! কারণ, জঙ্গলই ছিল তার জীবনদাত্রী, তার মা। ঠিক টারজানের মতই জঙ্গলের সুরক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন আরও একজন! নাহ! টারজানের মতো তিনি কোনও বিদেশী গল্প-কথার চরিত্র নন। বরং বাস্তবে এই দেশেই সাক্ষাৎ মেলে তাঁর। তিনি যমুনা টুডু। স্থানীয়দের ভাষায় ‘দ্য লেডি টারজান’।
ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূমের চাকুলিয়ার বাসিন্দা যমুনা টুডু। বিয়ের আগে তাঁর ঠিকানা ছিল ময়ূরভঞ্জ। সেখানেই রুক্ষ জমিতে গাছের চারা পুঁতে তাদের যত্ন করতেন যমুনা দেবীর বাবা। পরম মমতায় চারাগুলিকে বড় করে তুলতেন তিনি। ঠিক তখন থেকেই গাছের প্রতি এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা জন্মায় যমুনাদেবীর। বিয়ের পর ঝাড়খণ্ডে আসেন তিনি। তারপর থেকেই নিঃসন্তান এই আদিবাসী মহিলার কাছে জঙ্গলই যেন এক সন্তান! আর সেই ‘সন্তান’-এর সুরক্ষাতেই বারবার এগিয়ে এসেছেন তিনি। প্রায় দেড় দশক ধরে এ কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। প্রায় একা হাতেই রুখেছেন কাঠ মাফিয়া এবং চোরা গাছ চালানকারীদেরও। সম্বল বলতে নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং অসীম সাহস। তার ওপর ভরসা করেই আজ তিনি ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলের রাণী।
চাকুলিয়ার আসার পর যমুনা দেবীর নজরে আসে আশেপাশের শাল বন কেটে গাছ পাচারের ঘটনা। ব্যাস! আর কী! বিয়ের পর পরই অভিযানে নেমে পড়লেন তিনি। শুরু হল লড়াই। প্রতিনিয়ত জঙ্গল বাঁচানোর অভিযান। মাত্র ৬ জন মিলে গড়ে তুললেন এক দল। কোথাও কোনও গাছ কাটা বা চালানের খবর পেলেই ছুটে যেতেন তাঁরা। হাতে নাতে ধরতেন অপরাধীদের। তবে সব কিছু এত সহজ কিন্তু মোটেও ছিল না। চোরা গাছ চালানকারীদের রুখতে গিয়ে বহুবার আঘাতও পেয়েছেন যমুনা দেবী। তবু থেমে থাকেননি তিনি। তাঁর সেই অসীম সাহসকে পাথেয় করেই এগিয়ে গিয়েছেন বারবার।
২০১৪ সালে ‘শক্তি’ পুরস্কারে ভূষিত হন যমুনাদেবী। ২০১৬ সালে সাহসিকতার জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। সম্প্রতি ২০১৯ সালে সম্মানিত হন ‘পদ্মশ্রী’তেও। একই সঙ্গে যমুনাদেবী পাশে পেয়েছেন স্বামী সহ তাঁর গ্রামের সাধারণ মানুষকেও। তাঁর সেই ৬ জনের দল এখন পরিণত হয়েছে ‘বন সংরক্ষণ সমিতি’তে। গ্রাম এবং তার আশপাশের অঞ্চলে নজরদারির কাজে নিযুক্ত হয়েছেন গ্রামেরই বহু বাসিন্দা। সবুজ বাঁচাতে আজ পথে নেমেছেন তাঁরাও। তবে এখানেই শেষ নয়। বর্তমান করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই পরবর্তীতে সিংভূম পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও সবুজ বাঁচানোর বার্তা ছড়িয়ে দিতে বিশেষভাবে উদ্যোগ নিয়েছেন যমুনাদেবী। তাঁর সমিতিকে সঙ্গী করেই তিনি এগিয়ে যেতে যান আগামী ভবিষ্যতের দিকে। পরিবেশ সুরক্ষার লড়াইয়ে জিতে ফিরতে তিনি বদ্ধপরিকর। তাঁর চোখে আজ শুধুই সবুজের স্বপ্ন! এই স্বপ্নকে বাস্তবের রূপ দিতেই যে পথে নেমেছেন যমুনাদেবী। সফল যে তাঁকে হতেই হবে…
Discussion about this post