নদীয়ার কৃষ্ণনগর, পশ্চিমবঙ্গের একটি শহর যা তার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। এই শহরে অনেকগুলি জগদ্ধাত্রী পুজো হয়, তবে মালোপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজো একটি অনন্য আচারের জন্য সারা রাজ্যে পরিচিত। এই পুজোতে দেবী জগদ্ধাত্রীকে জলেশ্বরী রূপে পুজো করা হয়। আর এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি আজব প্রথা। এখানকার ছেলেরা শাড়ি পরে মাতৃ মূর্তির জন্য জল ভরতে যায়। এই দৃশ্য সত্যিই অনন্য এবং প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এই দৃশ্য দেখতে আসেন।
এই পুজোর শুরুতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি কৃষ্ণনগর রাজ্যের রাজা ছিলেন এবং জগদ্ধাত্রী পুজোর একজন উৎসাহী অনুসারী ছিলেন। মালো অর্থাৎ জেলেরা রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের জগদ্ধাত্রী পুজোয় প্রতিমা নিরঞ্জনের কাজটি করতেন। এক সময় তাঁদেরও ইচ্ছা হল জগদ্ধাত্রী পুজো করার। তাই তাঁরা রাজার কাছে একটি আবেদন জানায়। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাদের আবেদন মঞ্জুর করেন এবং পুজোর জন্য প্রয়োজনীয় সব সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। রাজা মালোদের পুজোর খরচ মেটাতে ১৫ টাকা দান করেন। আজও সেই নিয়ম মেনে রাজবাড়ি থেকে মালোপাড়ার পুজোর জন্য ১৫ টাকা দেওয়া হয়। এই টাকা না এলে মলোপাড়ার বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পুজোর কাজ শুরুই হয় না।
আবার শোনা যায়, রাজা সতীশ চন্দ্র রায়ের দ্বিতীয় রানী ভুবনেশ্বরী দেবী নাকি ১৫ টাকা দিয়ে এই মালোপাড়ার পুজোর শুভ সূচনা করেন। তারপর থেকে আজ অবধি এই পুজো সমানভাবে তার ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এই অনন্য প্রথার সূচনা কীভাবে হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিভিন্ন কিংবদন্তি রয়েছে। এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর কেউ জানে না। কেউ কেউ বলেন, এটি মাতৃশক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর একটি উপায়। আবার কেউ কেউ বলেন, এটি কোনও প্রাচীন রীতির অংশ। এই পুজোর একটি বিশেষ আকর্ষণ হল ধুনো পোড়া। ভক্তরা দেবীর কাছে মানত করেন ধুনো দেওয়ার, আর মানত পূরণ হলে দেবীকে ধুনো অর্পণ করেন। ধুনো পোড়ার ইতিহাস খুবই পুরনো। কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকেই এই রীতি চলে আসছে। তখন থেকেই মালোপাড়ার মানুষেরা মা জলেশ্বরীর কাছে মানত করে আসছেন। আর মানত পূরণ হলেই তারা ধুনো পোড়ান।
পুজো কমিটির সদস্যরা জানান, “এক সময় মালোপাড়ার পুজো দেখতে রাজা নিজে আসতেন। কিন্তু মাছের তীব্র আঁশটে গন্ধে রাজার যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্যই এখানে পুজোয় ধুনো পোড়ানোর চল শুরু হয়।” এখানে ধুনো পোড়ানোর রীতি খুবই আকর্ষণীয়। ভক্তরা সরা নিয়ে বসেন মায়ের সামনে। এই সরায় আগুন জ্বালিয়ে তার উপর ধুনো ছড়ানো হয়। ধুনো পোড়ানোর সময় পুরো মালোপাড়া উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। ধুনো পোড়ানোর পাশাপাশি এই পুজোর আরও অনেক ঐতিহ্য রয়েছে। এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মৃৎশিল্পের শহর কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্য। পুজোর মূর্তি তৈরি হয় কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মৃৎশিল্পীদের হাতে। মালোপাড়া বারোয়ারি পুজো কেবল একটি পুজো নয়, এটি একটি ঐতিহ্য, একটি সংস্কৃতি। এই পুজোর মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে একটি বিশেষ রীতি, একটি বিশেষ ভক্তি।
Discussion about this post