সাল ১৯৮৫। বেগম বিলায়েৎ মহেল হাজির দিল্লীর রেলস্টেশনে। সঙ্গে ১৫ টি শিকারী কুকুর! বিলায়েৎ মহেলের পরিচয়? আওয়ধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের প্রপৌত্রী! যে ওয়াজিদ আলী শাহের সৌজন্যে বাঙালির আলাপ ঘটেছিল বিরিয়ানির সঙ্গে।
বেগমের সঙ্গে রেলস্টেশনে উপস্থিত মেয়ে ‘প্রিন্সেস’ সাকিনা মহেল এবং ছেলে ‘প্রিন্স’ আলি রেজা ওরফে সাইরাস। ১২ জন নেপালি চাকর ও ছিল সঙ্গে। কিন্তু সহসা এরকম আগমনের কারণ? সাল ১৯৭১, তৎকালীন সরকার নবাবদের পেনশন বন্ধ করে দেন। এদিকে নবাব বংশে আর্থিক সঙ্কট! অগত্যা বেগমের এই উদ্যোগ। নিজেদের দাবি না মানা পর্যন্ত রেলস্টেশনের ভি.আই.পি ওয়েটিং রুমেই কাটিয়ে দিলেন ৯ বছর! অবশেষে নবাব বংশের ‘প্রাইভেসি’র কথা মাথায় রেখে ব্যবস্থা করা হল চাণক্যপুরীর সাতশো বছরের পুরোনো এক প্রাসাদ। মালচা গাঁওয়ের মালচা মহল।
ফিরোজ শাহ প্রতিষ্ঠিত মালচা মহল ততদিনে জরাজীর্ণ এক পোড়ো মহল। দরজা আছে, পাল্লা নেই। নেই জল-বিদ্যুৎ এর সংযোগও! নির্জন পোড়ো প্রাসাদে গিয়েও শান্তি কোথায়? শুরু হল হানাদারদের উৎপাত! প্রায়শই মহলে হানা গুপ্তধনের লোভে। মহলের বাইরে টাঙানো হল সাইনবোর্ড “প্রবেশ সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ।” ভুতুড়ে তকমাও ততদিনে জুটে গেছে মহলের গায়ে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা বেগম ও তাঁর পরিবার। লখনউ থেকে সঙ্গে আনা সোনাদানাও বেচতে বেচতে ফুরোবার পথে। তাঁদের জন্য অবসাদের রাজ্য যেন একপ্রকার নির্ধারিত। পরিণাম – হীরের আংটি চুষে বেগমের মৃত্যু। মায়ের জন্য ছেলে মেয়ের বুক ফাটা আর্তনাদ। কেঁপে উঠল মহল। লোকে বলল ‘ভুতনিকা চিখ’! মায়ের মৃতদেহকে নিজেদের কাছে তাঁরা আগলে রাখল ১২দিন! কিন্তু তখনো বাতাসে মিলিয়ে যায়নি গুপ্তধনের গল্প। সেই লোভে মানুষ খুঁড়ে ফেলল বেগমের কবর! নিরুপায় সাইরাস বেগতিক দেখে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দিলেন।
এদিকে মহলে বন দপ্তরের লোকেদের অযাচিত হানা। ক্ষিপ্ত সাইরাস পোষা কুকুরদের নিজের হাত কামড়াতে বাধ্য করেন। সেই রক্তাক্ত হাত দেখিয়ে শেষমেশ সরকারী লোকেদের প্রস্থান। এবারে প্রিন্সের জুটে গেল ‘পাগলা’ উপাধিও। অন্যদিকে সাকিনা ততদিনে মা বিলায়েৎ মহলকে নিয়ে লিখেছেন বই। ‘The Unseen Princess Wilayat Mahal’। তবে প্রকাশিত হল নিউজিল্যান্ডে। বাইরের লোকেরা জানতে উৎসাহী, কেমন আছেন নবাব বংশ?
বিবিসি সাকিনার সাক্ষাৎকার নিতে এলে সোজা জানিয়ে দেন, “ইয়ে নবাবী আন বান্ শান কে খিলাফ হ্যায়!” উপরন্তু তাদের কাছে চেয়ে বসেন পিস্তল। দুনিয়া শুদ্ধ লোকের সামনে মরতে চান তিনি। কিন্তু সেইদিন অসফল হলেও অবসাদের বুনন ততদিনে মহলে বেশ পোক্ত। অবসাদের রাজ্যে ডুবে একদিন মৃত্যু হয় তাঁর। শেষপর্যন্ত দিদিরও মৃত্যু! সাইরাস মৃতদেহকে আঁকড়ে, ফ্রিজে রেখে দিলেন ১০ দিন। বিদ্যুৎ দপ্তর এ কথা জানতে পেরে কেটে দিল বিদ্যুৎ সংযোগ! ‘পাগলা’ রেজাও ডুবে গেলেন অন্ধকারের অতলে। মহলের জীর্ণস্তূপ থেকে আবিষ্কার করা হল রেজার মৃতদেহ! তাঁর দেহ শনাক্ত করল স্থানীয় এক মসজিদের লোকজন। সেই মসজিদ, যেখানে রেজা প্রায়ই যেতেন খিচুড়ি খেতে! ২০১৭ সালের ৭ নভেম্বর। শিরোনামে মালচা মহলের পুনরুত্থান।
আসলে সবই নবাবী বংশ মর্যাদার মায়াজালের ভুলভুলাইয়া! প্রবল অনাদর, অর্থকষ্ট হলেও মালচা মহলকেই যেন আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন নিজেদের মতো। অর্থসঙ্কট ছিল, তবে নবাবী আচার-আচরণ ছিল শেষদিন অবধি। মহলে পাওয়া নবাবী কার্পেট, সোনার তরবারি, দামি আলমারি, জুতো থেকে নীল নক্সা কাটা চিনেমাটির নবাবী বাসনপত্র এখনো বহন করে তাঁদের শৌখিনতার সাক্ষী! রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল নবাবী ঠাঁটবাট, নবাবী বংশমর্যাদা। কিন্তু কখনোই বেআব্রু করতে চাননি তাঁদের এই কপদর্ক শূণ্য অবস্থা। তাই নির্জনে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন এই মহলে। আর শেষপর্যন্ত মহলের দেওয়ালেই আটকে থাকল তাঁদের মৃত্যুর আর্তনাদও!
মূল ভাবনা, গবেষণা, চিত্র এবং তথ্য ঋণ – সঙ্ঘমিত্রা বনবিবি
Discussion about this post