দীপাবলি মানেই হাজার ঝলমলে খুশির রোশনাই। ঘরময় জ্বলে ওঠা দীপের সলতে, আনন্দের উচ্ছ্বাস। পাঁচদিন ব্যাপী নানা আচারের আয়োজন। কার্তিকের কৃষ্ণপক্ষের তেরোতম দিন থেকে শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয়া। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ আলোর মেলা। দীপাবলির প্রথমদিন ধনতেরাস। পরদিন ভূতচতুর্দশী। তারপর আসে দীপান্বিতা অমাবস্যা।
ধনতেরাস। এইদিন হিন্দু ঘরে নতুন অলঙ্কার কেনা শুভ। পুরাণ ঘাঁটলে উঠে আসে অনেক তথ্য। দুর্বাশা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মী একসময় নরকবাসী হন। অসুরদের সাথে দেবতাদের সমুদ্র মন্থনে এদিন উদ্ধার হন শ্রীলক্ষ্মী। আবার এও শোনা যায়,রাজা হিমুর পুত্রের জীবন রক্ষা করেছিল তার স্ত্রী। বহু অলঙ্কার ও প্রদীপ প্রজ্বলনেই, সাপরূপী যমরাজ ব্যর্থ হন হিমুপুত্রের জীবন নিতে। তাই হিন্দু ঘরে এদিন অলঙ্কার কেনার চল আসে। আবার হিন্দু পুরাণ মতে, এইদিন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার দেবতা ধন্বন্তরী সমুদ্র মন্থনে উঠে আসেন। তাঁর এক হাতে অমৃতকলস অন্যহাতে আয়ুর্বেদ বই। ‘ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী’কে সংক্ষেপে ধনতেরাস বলা হতো। যদিও এটি মূলত অবাঙালিরাই এতকাল পালন করেছেন। কিন্তু আজ বাঙালি ঘরেও তা ঢুকে পড়েছে।
দীপাবলির দ্বিতীয়দিন অর্থাৎ চোদ্দতম দিনে ভূতচতুর্দশী। চোদ্দ শাক ও চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানোর আচার। বলা হয়, এইদিন পূর্বপুরুষরা আসেন এই ধরাধামে। বংশধরদের খোঁজখবর নিতে। প্রদীপ রোশনাইতে তাঁরা নিশ্চিন্ত হন বংশের ছোটরা সুখে আছে। তাই বিদায় নেন আবার নিজের সাম্রাজ্যে। আবার শোনা যায়, বলীরাজা বামনরূপী বিষ্ণুর তৃতীয়পদের ভারে নরকে বদ্ধ হন। কিন্তু তার দানশীলতায় মুগ্ধ বিষ্ণু শুধুমাত্র এই দিনটির জন্য তাঁকে নরক থেকে মুক্ত রাখেন। এই আলোর সজ্জায় গৃহস্থ থেকে দিগভ্রষ্ট করা হয়। যদিও এইসব লোককথা। তবে শাস্ত্রকথার অনেক সঠিক ব্যাখ্যাও হয়। হেমন্তের হালকা শীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেই চোদ্দ শাকের এই আচার পালন হয়।
অন্য জাতির রীতি-নীতি অনুকরণে বাঙালি জাতির আগ্রহ বরাবর। তাই দুর্গাপূজা শেষে আজ হয় বিদেশী ছাঁচের কার্নিভাল। অবাঙালির ধনতেরাস পালন হয় বাঙালি প্রতি ঘরে। কিন্তু আদি বাংলার আচার ভূত চতুর্দশী, সে আজ বিলুপ্তির পথে। ওদিকে মুখোশ পরে হ্যালউইন দিবসও পালন হচ্ছে বঙ্গের মাটিতে। পঁচিশ বছর আগে অবধি ধনতেরাসের গুরুত্ব ছিল না বাংলার জনজীবনে। কিন্তু আজ তাতেই ছাপিয়ে যাচ্ছে বাজার। হিড়িক বাড়ছে অলঙ্কার কেনার। তবে কি ঐতিহ্যের ভূত চতুর্দশীকে সত্যিই ভুলতে বসেছে বাঙালি? ব্যাপারটা দুঃখজনক। আদি গ্রামবাংলার সেই মেটে চিত্রেরও বিবর্তন ঘটেছে। নগরীকরণে পিছিয়ে নেই গ্রামবাংলাও। তাই চোদ্দ রকমের শাকের জোগাড় দুঃসাধ্য। তবে কালীপুজোর আগের দিন প্রদীপ জ্বলছে কোথাও কোথাও। যদিও সংখ্যা বেশ কম। সময় বদলেছে, বদলেছে মানুষের চাহিদা। বদলেছে জীবনশৈলী। কিন্তু কিছু পুরনো আচার রীতি বাংলার ঐতিহ্য। আর তা বজায় রাখার দায়িত্ব বাঙালিদেরই। আবার আগের মতোই ঘরে ঘরে ফিরুক বাঙালি আচার ভূত চতুর্দশী।।
Discussion about this post