বাংলার বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে নানান বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোর নানান ইতিহাস। বনেদি বাড়ির পুজো মানেই পুরোনো ঐতিহ্যের সম্ভার। এইসব বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোয় শুধুমাত্র দেবীর উপাসনা হয়না, বরং সেইসব দুর্গা পুজোর সাথে জড়িয়ে আছে শত বছরের প্রথা, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অটুট বন্ধন। তেমনই এক ইতিহাসসমৃদ্ধ পুজোর নিদর্শন পাওয়া যায় আগরপাড়া অঞ্চলের ইলিয়াস রোডের ছাতাপাড়া বাঁড়ুজ্জ্যে বাড়ির দুর্গা পুজোয়। এই বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোর শুরু বাংলার ১১৯৯ সালে, যা আজ অবধি অবিচলিতভাবে সতেরো পুরুষ ধরে উদযাপিত হয়ে আসছে। ইদানিংকালে থিমের ভিড়ে ঢাকা পড়ে গেলেও, এই বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোর সঙ্গে এমন কিছু ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে যেটা কিন্তু এই পুজোকে একেবারেই কিংবদন্তি করে তোলে।
ছাতাপাড়া বাঁড়ুজ্জ্যে বাড়ির পুজোর মূল আকর্ষণ হলো বিসর্জনে পান্তা খাওয়ার রীতি। ব্যানার্জি পরিবারের পূর্বপুরুষেরা ঢাকার হওয়ায়, এখানকার পুজোয় ঘটি ও বাঙালের মিশেল লক্ষ্য করা যায়। মা দুর্গাকে পান্তা খাওয়ানোর এই রীতি পুজোয় ঢাকার ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেয়। এছাড়াও, এই বনেদি বাড়ির বিসর্জনের রীতিও বেশ আকর্ষণীয়। বিসর্জনের দিন ছাতাপাড়া বাঁড়ুজ্জ্যে বাড়ির দুর্গা পুজোয় এক বিশেষ রীতি রয়েছে, যা এই পুজোর ঐতিহ্যকে অনন্য করে তুলেছে। এই বাড়ির পুজোয় মাকে কাঁধে করে গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়, যা আজও অত্যন্ত উৎসাহ এবং শাস্ত্রীয় আচার মেনে পালন করা হয়।
অতীতে প্রতিমা নিরঞ্জন হতো গঙ্গার বুকে দুই নৌকায় বসিয়ে এবং মাকে মাঝিরা কাঁধে করে নিয়ে যেতেন বিসর্জনের স্থান পর্যন্ত। যদিও আজকের দিনে মাঝির অভাব এবং নিরাপত্তার কারণে নৌকা-নিরঞ্জন প্রথাটি বিলুপ্ত হয়েছে, তবে কাঁধে করে প্রতিমা নিয়ে যাওয়ার রীতি এখনও অবিচল। এই পুজোর চারদিন পুরুষরা শুধুমাত্র ধুতি, গেঞ্জি এবং কোমরে একটি গামছা বেঁধে থাকেন। একসময় এই পুজোয় মহিষ বলি দেওয়ার প্রথা ছিল, পরে তা পাঁঠা বলিতে রূপান্তরিত হয়। তবে বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলির প্রথাটি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিন্তু সেই প্রথার পরিবর্তে পুজোর আচার-অনুষ্ঠানে যোগ হয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
দশমীর দিন বেনারসি পরিহিত মেয়ে-বউরা মাকে বরণ করেন, আর তারপর শুরু হয় ধুমধাম করে সিঁদুর খেলা আর সিদ্ধির সরবত পান। মায়ের বিদায়ের মুহূর্ত যেন হয়ে ওঠে আবেগে ভরা, যা ঐতিহ্যের রঙে মাখানো। বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোগুলোতে আমরা দেখতে পাই একদিকে গভীর শিকড়-যুক্ত ঐতিহ্য, অন্যদিকে আধুনিকতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রবণতা। ছাতাপাড়া বাঁড়ুজ্জ্যে বাড়ির পুজোও তার ব্যতিক্রম নয়। পুরনো আচার-অনুষ্ঠানগুলোর সাথে নতুন প্রজন্মের ভাবনা মিলে গিয়ে পুজোটি হয়ে উঠেছে সময়োপযোগী। তবুও, পুজোর প্রতিটি ধাপে আজও ছড়িয়ে আছে ঐতিহ্যের সুবাস।
Discussion about this post