বিশ্বের সবচেয়ে সফল আন্তর্জাতিক জলচুক্তিগুলির মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত ভারত পাকিস্তানের সিন্ধুচুক্তি। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও, এটাই সত্যি। এতদিন ধরে বহু যুদ্ধ, বহু উত্তেজনা, বহু হিংসার মাঝেও চুক্তিটি এখনও পর্যন্ত কার্যকর ছিল। আজ সকলেই জানেন, ভারত সরকার এই চুক্তি রদ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তাতে খুশি হয়েছেন, বদলার উল্লাসে মেতেছেন অনেকেই। “আচ্ছা জব্দ করা যাবে পাকিস্তানিগুলোকে, জল বন্ধ করে দিয়ে ওদের থেকে বেশ বদলা নেওয়া যাবে”- এই বলে নাচানাচি করছেন ভারতীয়দের একাংশ। তবে, আসল বিষয়টি কী? এই চুক্তি রদ করার জন্য কী পরিবর্তন হতে পারে উপমহাদেশীয় জিওপলিটিক্সে, আসুন বুঝে নিই।

২০২৫-এর ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামে নৃশংস জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছেন ২৬ জন, আহত আরো অনেকে। প্রত্যুত্তর হিসেবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত বেশ কিছু কর্মসূচি নিয়েছে। তারমধ্যে একটি সিন্ধুজলচুক্তি রদ। এই সিন্ধু জলচুক্তি (Indus Waters Treaty) হল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশ শান্তিপূর্ণভাবে সিন্ধু ও তার উপনদীগুলির জল ব্যবহারের অধিকার পেয়েছিল। এই জলচুক্তি এমনভাবে তৈরি হয়েছিল, যাতে ভারত নদীগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখলেও, পাকিস্তান যেন তার প্রাপ্য প্রাকৃতিক জলের প্রবাহ থেকে বঞ্চিত না হয়। চুক্তির স্বাক্ষরকারীরা ছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু; পাকিস্তানের পক্ষে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আইয়ুব খান এবং মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট ইউজিন ব্ল্যাক। ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে বিভক্ত হওয়ার পর, সিন্ধু নদীর জল নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কারণ নদীটির উৎস ছিল ভারতে, কিন্তু প্রধান প্রবাহ পাকিস্তানে। ১৯৪৮ সালে ভারত জলপ্রবাহ বন্ধ করে দিলে পাকিস্তানে খাদ্য ও কৃষিজ সমস্যা দেখা দেয়। ১৯৫২ সাল থেকে দীর্ঘ আলোচনার পর ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, করাচিতে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শর্ত ছিল, ছয়টি নদীগুলি দুটি ভাগে ভাগ হবে। পূর্বাঞ্চলের তিনটি নদী, যথা- রবি, বিয়াস, ও সুতলজ– এগুলির জল ব্যবহার করবে ভারত। পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি নদী যথা- সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাব – এদের জল ব্যবহারের অধিকার পায় পাকিস্তান।
সিন্ধুচুক্তি রদের ফলে, ভারত প্রথমত পশ্চিমাঞ্চলের নদীর উপর নির্মিত বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে জল ছাড়া বন্ধ করতে পারে। তবে প্রাকৃতিকভাবে নদীগুলির জলপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, চেনাব নদীর ওপর অবস্থিত বাগলিহার বাঁধ জল ধরে রাখলে, পাকিস্তানে জলপ্রবাহ আপাতভাবে হ্রাস পাবে। এছাড়া, ভারত পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলোর উপর কাঠামোগত উন্নয়ন দ্রুততর করতে পারে, যেমন চেনাব নদীর ওপর পাকাল দুল (১,০০০ মেগাওয়াট) এবং সাওলকোট (১,৮৫৬ মেগাওয়াট) বাঁধের মতো জলাধার প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করলে ভবিষ্যতে চেনাব নদীর জলের ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়বে।
এতে পাকিস্তানের কতখানি সমস্যা হতে চলেছে? পশ্চিমের নদীগুলির ৭০% জলপ্রবাহ আসে হিমবাহ থেকে, ২০% আসে বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাত থেকে – যা ভারতের নিয়ন্ত্রণে নেই। ভারত জলপ্রবাহ বন্ধ করলেও প্রতি বছর প্রাকৃতিকভাবে ১৩১.৪ MAF জল পাকিস্তানে পৌঁছাতে থাকবে। বর্ষাকালে নদীগুলির জলপ্রবাহ ৫,৮০০ ঘন মিটার/সেকেন্ড (m³/s)-এর বেশি হয়, ফলে কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হয় না। তাই বড় ধরনের কোনো প্রভাব বোঝা কঠিন। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলি স্পষ্ট হবে তখনই, যখন ভারত তার বড় প্রকল্পগুলিকে দ্রুত বাস্তবায়ন করবে। সিন্ধুর বিপুল পরিমাণ জল ভৌগোলিক এবং প্রাকৃতিক কারণে পাকিস্তানে প্রবাহিত হতেই থাকবে। পশ্চিমের নদীগুলি থেকে নিয়ন্ত্রিত জলপ্রবাহ কিছুটা কমানো সম্ভব হলেও, পাকিস্তানে পৌঁছন মোট জলপ্রবাহের বেশিরভাগটাই প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হয় এবং তা ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সম্পূর্ণভাবে জলপ্রবাহ বন্ধ করতে গেলে ভারতের বিশাল পরিমাণে পরিকাঠামোগত বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। ফলে, সোশ্যাল মিডিয়াতে উল্লাসে ফেটে পড়া ভারতীয়ের একাংশের লম্ফঝম্ফ সম্ভবত ততখানি যুক্তিযুক্ত নয়। ভবিষ্যতে কী হয়, তা দেখা এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।
Discussion about this post