বর্ধমান-বীরভূম সীমান্তে অজয় নদী, অজয় নদীর তীরে অবস্থিত কেন্দুলি গ্রাম। কেন্দুলি গ্রামের ইতিহাস কম বেশি সকলেই জানেন। ‘গীতগোবিন্দে’র কবি জয়দেবের জন্মস্থান এই কেন্দুবিল্ব গ্রাম। রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেব মিশ্র। ফলত এই গ্রামের ঐতিহ্য প্রায় আটশ বছরেরও পুরাতন। জয়দেবের জন্মদিনে প্রতি বছর ধারাবাহিক মেলার কথাও মানুষের অজানা নয়। কিন্তু, এই ঐতিহ্যের বাইরেও জয়দেব-কেন্দুলির খুব কাছেই রথের যে প্রাচীন শিল্পের ঐতিহ্য রয়েছে, তার খোঁজ রাখেন না অনেকেই।
ঐতিহ্যমন্ডিত কেন্দুলি গ্রাম থেকে মাত্র বারো কিলোমিটার দূরেই বনকাটি গ্রাম। ভাষাবিদ সুকুমার সেন বলেছিলেন অজয়ের তীরে এই বনকাটি গ্রামের মুখোপাধ্যায় পরিবারের পিতলের রথটি বাংলার ৪২ টি পিতলের রথের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। শিল্পী নন্দলাল বসু তাঁর ছাত্রদের এই রথের শিল্প এবং কারুকাজ দেখাতে নিয়ে আসতেন। বাংলার এচিং শিল্পের জনক মুকুলচন্দ্র দে তাঁর ছাত্রদের নিয়ে আসতেন কাজ শেখাতে। নন্দলাল বসুর দৌলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজ পাঠে’র অলঙ্করণেও রয়েছে এই রথের গায়ের শিল্পের প্রভাব। এছাড়া শান্তিনিকেতনের কলাভবনে কালো বাড়ির গায়ে এই রথের শৈল্পিক চিত্রের প্রতিলিপি আছে। নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ ও তাঁদের ছাত্ররাই এই কালো বাড়ির দেওয়ালের অলঙ্করণ করেছিলেন মাটি ও আলকাতরা দিয়ে।
মনে করা হয় লাক্ষা ব্যবসায়ী জমিদার রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই রথ নির্মাণ করিয়েছিলেন। রথটি ১৫ ফুট উচ্চতার আটটি চাকা যুক্ত। মাথায় রয়েছে বিষ্ণুচক্র। পিতলের দুই ঘোড়া এবং সারথি আছে এই রথে। রথের দেওয়ালে খোদাই করা রয়েছে মহাভারত, রামায়ণের যুদ্ধযাত্রার ছবি, সৈনিকদের অবয়ব ছাড়াও মৈথুন দৃশ্য, সামাজিক নরনারীর নানান চিত্রণ। প্রখ্যাত শিল্পীরা এর এচিং, ড্রইং ও পটচিত্রের ছাপের প্রশংসা করেছেন। সম্ভবত ১২৪২ বঙ্গাব্দের কাছাকাছি সময়ে এই পিতলের রথ তৈরি হয়েছিল। তৈরি হতে সময় লেগেছিল ছয় থেকে আট মাস। এই প্রাচীন রথ দেখতে একসময় দূরদূরান্ত থেকে দর্শকরা আসতেন। বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে এই প্রাচীন শিল্পের নিদর্শনটি।
Discussion about this post