গত দু’বছরে করোনার ভ্রুকুটি গোটা দেশ তথা গোটা বিশ্বে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ইতিহাসে এমন অনেক মহামারির উল্লেখ আছে। যুগে যুগে বিশ্ব বিভিন্ন মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছে। মারণযজ্ঞ চলেছে, লাখ লাখ মানুষ অজানা রোগে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে এ রকম প্রাণঘাতী অনেক মহামারির উদাহরণ পাওয়া যাবে। তেমনই এক অজানা ভাইরাসের কবলে পড়েছিল গোটা ইউরোপ। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও, ঘুমের মধ্যে অকাতরে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় দশ লাখেরও বেশি মানুষ।
সময়টা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক। ইউরোপের বুকে তখন বেজে উঠেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। আর ঠিক এই সময়ই নতুন এক ভাইরাসের আতঙ্ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল গোটা ইউরোপ জুড়ে। ভাইরাস সম্বন্ধে তেমন কোনো ধারণা তখনও তৈরি হয়নি বললেই চলে। কিন্তু গবেষণা বলছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে মারা যাওয়া সৈনিকের চেয়ে কয়েকগুণ মানুষ বেশি মারা যায় এই মহামারিতে। ডাক্তারি পরিভাষায় এই রোগের নাম,‘এনসেফেলাইটিস ল্যাথার্জিকা’। যে রোগের ধাঁধা ডাক্তারি মহলে এখনো অধরা রয়ে গেছে। ১৯১৬ সালে এমনই এক মহামারির সাক্ষী হয়েছিল বিশ্ব। তবে অজানা এ রোগের উপসর্গ তেমন ভয়ঙ্কর ছিল না। ঘুমন্ত অবস্থাতেই প্রাণ যেত আক্রান্তদের। ইতিহাসে তাই এই রোগ ‘ঘুম রোগ’ নামেও পরিচিত। আক্রান্তরা ঘুমে আচ্ছন্ন থাকত সবসময়।
তবে এই ঘুম যে তাদের চিরনিদ্রায় পরিণত হচ্ছে তা তারা টেরও পেতেন না। ইতিহাসের তথ্য অনুসারে, এ রোগে আক্রান্তরা পুরোপুরি সচেতন আবার পুরোপুরি অচেতনও থাকত না। তারা প্রাণহীন মূর্তির মত নির্বাক হয়ে বসে থাকত। সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হলো, এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীরা তাদের কোনো অসুবিধার কথা অনুভবই করতে পারত না, তাই অনুভূতি প্রকাশেরও কোনো প্রশ্ন ছিল না। উল্লেখ্য, এই নিদ্রাচ্ছন্নতা কাটিয়ে যারা বেঁচেছিলেন, তারা স্বাভাবিক জীবন আর ফিরে পাননি। অনেকটা প্রতিবন্ধীর মতো বাকি জীবন কাটান তারা।
১৯১৬ সালে ভের্ডনের যুদ্ধ ফেরত এক সৈনিকের শরীরে প্রথম এই রোগটির প্রভাব দেখা যায়। শুধু ইউরোপ নয়, কিছুদিনের মধ্যেই নিউ ইয়র্কেও এক ব্যক্তির শরীরে ফুটে উঠেছিল অনুরূপ উপসর্গ। ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর আকারে মানুষের শরীর থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল বহু কুকুরের শরীরেও। অবশেষে ভিয়েনার এক স্নায়ুবিদ, ভন ইকোনমো রোগের প্রভাব সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা দিলেন। এই রোগের প্রকোপ যাদের উপর এসে পড়ছে, তাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশটি ক্রমশ শুকিয়ে আসছে। আর এর ফলেই ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে তাদের শরীরে। প্রায় ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত এই রোগের প্রকোপ চলেছিল। তারপর দেখা যায়, অ্যান্টি-ভাইরাস ওষুধের সাহায্যে এই রোগ নিরাময় সম্ভবপর হয়েছে। তবে এমন বিস্ময়কর অসুখ পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই এসেছে। চার দশকের বেশি সময় ধরে যে কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এই রোগ, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ২০১০ সালে, এনসেফালাইটিস লেদারজিকার সম্পর্কিত ঐতিহাসিক এবং সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে বলা হয়, “আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, এনসেফালাইটিস লেদারজিকার রোগটি এখনও প্যাথলজিকাল ধাঁধা হিসেবে অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।”
Discussion about this post