শিক্ষক দিবস ইদানিংকালে আর সব দিবসের মতোই কেবল সেলিব্রেশনের দিন হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষক শিক্ষিকার সাথে ছবি পোস্ট করে কেউ সারছেন কর্তব্য, কেউ বা উপহারে মুড়ে দিচ্ছেন তাদের শিক্ষকদের। উল্টো দিকে শিক্ষকরাও একদিনের ছুটিতে ছাত্রছাত্রীদের ভালো মন্দ খাইয়ে খুশি করে চলেছেন। কিন্তু এসব দিয়ে আদৌ কি রক্ষিত হচ্ছে শিক্ষক দিবসের গুরুত্ব? আদৌ প্রাপ্য সম্মানটুকু পাচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা? সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা মেরুনা মুর্মুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাই তথাকথিত শিক্ষক দিবসের মাধুর্যকে এক কঠিন প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।
আমরা সকলেই জানি দীর্ঘ জল ঘোলার পরেও সুপ্রিম কোর্ট রায় হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসির পক্ষেই। মহামারীকালে প্রায় দীর্ঘ ৬ মাস ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার সাথে বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। বন্ধ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এহেন অবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধের কথা মাথায় রেখেই অধ্যাপিকা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছিলেন, “এই ভয়াবহ মহামারীতে পরীক্ষা নয়, কারণ জীবনের চেয়ে দামী কিছু নয়।” আর তাতেই তার অধ্যাপিকার পরিচয় নিমেষে ধূলিসাৎ করে তাকে তাঁর জাত চিনিয়ে দেয় বেথুন কলেজের তৃতীয় বর্ষের বাংলা অনার্সের ছাত্রী পারমিতা ঘোষ। জাতি বিদ্বেষী ভাবধারা নিয়ে লাগাতার আক্রমণ করা হয় অধ্যাপিকাকে। ‘কোটা’ বা তফসিল জাতির সংরক্ষণের বিষয়টি উল্লেখ করে অধ্যাপিকাকে ‘ফাঁকিবাজ’ এবং ‘অযোগ্য’ হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন বেথুনের ওই ছাত্রী।
অধ্যাপিকাকে ‘আদিবাসী’ বলে দাগিয়ে দিয়ে পারমিতা তার সোশ্যাল মিডিয়ায় অকপটে লেখেন, “সকালবেলা এক মুর্মূ সাঁওতালিকে শুধু মনে করিয়েছিলাম সে আসলে এক আদিবাসী, তাও মার্জিত ভাষায়। কিন্তু তার বয়সের কাকু-কাকিমারা মনে করিয়ে দিল ঘরে বসে বিনা পরিশ্রমে কিছু তথাকথিত ‘অধ্যাপিকা’ বেতন চর্বির স্তর আরও পুরু করে দিয়েছে।” ঘটনার জেরে কার্যতই হতবাক অধ্যাপিকা। তিনি এই প্রসঙ্গে লেখেন,” যাই বলি তাতেই দেখি ‘সব পথ এসে মিলে গেল শেষে’ আমার পদবীতে।” নেট দুনিয়ায় শোরগোল পড়তেই বেথুনের ছাত্রী অ্যাসোসিয়েশন ছাত্রীটিকে সমালোচনা জানিয়ে পোস্ট দেয় এবং ক্যাম্পাসে জেণ্ডার সেনসেটাইজেশানের ডাক দেয়। কিন্তু সেখানেও কলকাতার তথাকথিত শিক্ষিত উচ্চবর্ণের একাংশ তাদের জাতি বিদ্বেষ উগড়ে দিয়ে পারমিতার পক্ষে সাফাই গায়। তাঁরা স্পষ্ট জানায় অধ্যাপিকাকে জাত তুলে অপমান করাটা পারমিতার বাক স্বাধীনকার অধীনেই পড়ে এবং সে ঠিকই বলেছে।
জাতি বিদ্বেষী মানসিকতা সমাজের কতটা গভীর অবধি তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে তার আরেকটি উদাহরণ সামনে আনেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র রীতম দাস। যেখানে দেখা যায়, আশুতোষ কলেকের গণিত বিভাগের এক প্রাক্তনী তফসিল জাতির মানুষদের পাবজি এবং টিকটকের মত ব্যান হয়ে যাওয়া দুটি অ্যাপের সঙ্গে তুলনা করে একটি মিম শেয়ার করেন। সেই পোস্টের বিরোধিতা করতেই রীতমকেও পড়তে হয় নানান হামলার মুখে। শিক্ষকের মান নির্ধারণ করার মাপকাঠি এখন তবে পদবী? প্রশ্ন থেকেই যায়। মেরুনা মুর্মূরা প্রথম নয়, এর আগেও বারংবার মানুষের যোগ্যতার বিচার করা হয়েছে তাদের জাত দিয়ে, পদবী দিয়ে। আর এই শিক্ষক দিবসের গালভরা ‘সেলিব্রেশনে’ ক্রমেই হারাতে বসেছে শিক্ষকদের প্রাপ্য সম্মান। আর সব পেশার মতোই শিক্ষকরাও ক্রমেই হয়ে উঠছেন কোনও এক সংস্থার কর্মচারী। তবু সেলিব্রেশন চলবে, তবু পালিত হবে ‘শিক্ষক দিবস’।
Discussion about this post