শারদোৎসবের নায়িকা যদি হন দশভুজা দেবী দুর্গা, তবে তাঁর বধকৃত অশুভ শক্তির প্রতীক মহিষাসুর। প্রতি বছর দুর্গাপুজোকে ঘিরে বাঙালি সমাজ আনন্দে মেতে ওঠে দেশ-বিদেশে। কিন্তু এই আনন্দোৎসবের ভিন্ন এক প্রতিচ্ছবি দেখা যায় পুরুলিয়ার ফলাওরা গ্রামে। সেখানে শারদীয়া মানেই উল্লাস নয়, শোক। খেরওয়াল সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কাছে দুর্গাপুজো পালিত হয় না, বরং পালিত হয় হুদুর দুর্গা—যা কোনও আনন্দ উৎসব নয়, বরং শহিদপুরুষের স্মৃতিচারণ।
খেরওয়ালদের বিশ্বাস, হিন্দু পুরাণে মহিষাসুর নামে পরিচিত যিনি, তিনি আসলে তাঁদের পূর্বপুরুষ, এক পরাক্রমী রাজা হুদুর। তিনি বসবাস করতেন চাইচম্পা নামে এক সমৃদ্ধ জনপদে। রাজ্যের মানুষজন শান্তি ও সমৃদ্ধিতে জীবন কাটাতেন। কিন্তু সেই ভূমির প্রতি লোভ জাগে আর্যদের। একের পর এক আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে তাঁরা উপলব্ধি করেন, রাজা হুদুরের অদম্য শক্তির কারণে জয় অসম্ভব।
কথিত আছে, খেরওয়ালরা কখনও নারীর উপর আক্রমণ করেন না—এই বিশ্বাসকে হাতিয়ার করেই হুদুরের বিরুদ্ধে ফাঁদ পাতা হয়। এক আর্যকন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেওয়া হয়। কিন্তু নববিবাহিতা সেই নারী পরবর্তীতে স্বামী হুদুরকে প্রতারণার মাধ্যমে হত্যা করেন। খেরওয়ালদের মতে, এই নারীই হিন্দু পুরাণের দেবী দুর্গা। তাঁদের দৃষ্টিতে তিনি এক ‘উচ্চবর্ণের নারী’, যিনি ছলনার আশ্রয়ে তাঁদের রাজার মৃত্যু ঘটান।
রাজা হুদুর নিহত হওয়ার পর আর্যরা অন্যায়ভাবে চাইচম্পা দখল করে নেয়। ভিটেমাটি হারিয়ে খেরওয়াল সম্প্রদায়কে পালাতে হয় নিজ ভূমি থেকে। সেই ক্ষত আজও তাঁদের সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে জীবন্ত। তাই শারদোৎসব তাঁদের কাছে আনন্দ নয়, বরং বেদনার সময়। এই প্রাচীন কাহিনীকে স্মরণ করেই প্রতি বছর শারদীয়ার সময়ে খেরওয়াল সাঁওতালরা পালন করেন হুদুর দুর্গা প্রথা। এখানে দেবীর বন্দনা নেই, নেই আনন্দোৎসবের রং—আছে কেবল শোকের আচার, পূর্বপুরুষের স্মৃতি এবং পরাজয়ের ইতিহাস।
Discussion about this post