উত্তর পূর্বাঞ্চলে কৃষির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কোচ-রাজবংশীরা। তারা প্রথম থেকেই তাদের কৃষি সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। কিন্তু প্রখর গরমে চাষের জমিকে শস্য শ্যামলা রাখতে বৃষ্টির প্রয়োজন। অতিবৃষ্টির কারণে যেমন বন্যা হয়, ঠিক তেমনি অনাবৃষ্টির কারণে খরা। কৃষিপ্রধান এলাকায় বন্যা ও খরা উভয়ই ক্ষতিকর। তাই সাধারণ মানুষ অতিবৃষ্টিতে দেব-দেবীর শরণ নেয়, তেমনি অনাবৃষ্টির ক্ষেত্রেও। অনাবৃষ্টি থেকে কৃষিকাজকে রক্ষার জন্য ‘হুদুম দেও’র শরণ নেওয়া হয়। তাই বৃষ্টির কামনায় পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, দার্জিলিং, বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর এবং আসামের গোয়ালপাড়া অঞ্চলের কোচ রাজবংশী জনজাতির মহিলারা ‘হুদুম দেও’ পুজো করেন।
উত্তরবঙ্গের কৃষক রমণীদের মধ্যে একজন বিদ্বেশ্বরী। আর সেই কৃষক রমণীদের ভরসা ‘হুদুম দেও’। এক গভীর রাতের অন্ধকারে গ্রামের কোনো এক গোপন জায়গায় নারীর দল জড়ো হয়। এরপর মশাল জ্বালিয়ে তাদের নৃত্য-গীতের মাধ্যমে ‘হুদুম দেও’কে তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, হুদুম খুশি হলে নামবে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির ফলে উত্তরবঙ্গের চাষের ক্ষেত হয়ে উঠবে শস্য শ্যামলা।
পুজোর জন্য কোনও এক সন্তানের মায়ের স্নানের জল, গণিকার চুল, ধূপ-বাতি, নৈবেদ্য, কুলো, জলপূর্ণ ঘট, ফিঙে পাখির বাসা, গোটা পান-সুপারি এবং বরণডালা প্রয়োজন হয়। এই পুজোতে একটি কলা গাছেরও প্রয়োজন হয়। পুজোর স্থানে একটি গর্ত খোঁড়া হয়। এরপর উলুধ্বনি দিয়ে পুজো শুরু হয়। দলনেত্রী ওই গর্তে সমস্ত সামগ্রী সহ কলা গাছটি পুঁতে দেন। খুঁটি পোতার সাত দিন আগে প্রধান দলনেত্রীর আহ্বানে প্রতিদিন ৭-৮ জন মহিলা ‘মাগন’ করতে বেরোন। দলনেত্রী লাঠি ঠুকতে ঠুকতে শব্দ করে আগে যান। বিভিন্ন বাড়ি থেকে ‘মাগন’ করে আনা সাত ঘরের জল ছিটিয়ে দেওয়া হয় সেই গাছে।
তারপর সবাই স্নান করে শুদ্ধ হয়ে আসেন। এরপর মেঘ দেবতার প্রতীক কলা গাছটিকে স্নান করানো হয়। বারো শস্য দিয়ে কলা গাছের নীচে ঘট স্থাপন করে ধূপ–বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পুজো শেষে নৃত্য-গীতের মাধ্যমে হুদুম দেবতাকে খুশি করার চেষ্টা করা হয়। এই অনুষ্ঠানে পুরুষদের অংশগ্রহণ করা অথবা দেখা দুটিই নিষিদ্ধ। হুদুম আসলে বৃষ্টির দেবতা বরুন বা ইন্দ্র। জানা যায়, হুদুমের পুজো করা হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের কোনও শনি বা মঙ্গলবার। এই পুজোতে বিবাহিত এবং বিধবা মহিলারা অংশগ্রহণ করেন। কুমারী মেয়েদেরও এই পুজোয় অংশগ্রহণ করা বারণ।
চিত্র ঋণ :- heritagefoundation.org.in
Discussion about this post